মূর্তি নদীর কান ঘেঁষা জলদাপাড়ার 'হলং', আশ্চর্য ডুয়ার্সে কয়েকদিন
পাহাড়ের কোলে তরাই অঞ্চলের সৌন্দর্য্যের বর্ণনা বহু কলমচির লেখনিতে পাওয়া যায়। তা চাক্ষুষ করার আকাঙ্খাও ছিল মনে-প্রাণে। কিন্তু দৈনিক ব্যস্ততা ছিল তার অন্তরায়।
পাহাড়ের কোলে তরাই অঞ্চলের সৌন্দর্য্যের বর্ণনা বহু কলমচির লেখনিতে পাওয়া যায়। তা চাক্ষুষ করার আকাঙ্খাও ছিল মনে-প্রাণে। কিন্তু দৈনিক ব্যস্ততা ছিল তার অন্তরায়। অবশেষে ডুয়ার্স ভ্রমণের সুযোগ যখন এল, তখন নিজের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস জন্মাল। সামসিং, ঝালং, বিন্দুর রূপ প্রত্যক্ষ করা কী কম পুণ্যের কথা।
সেই পুণ্যের পাট চুকিয়ে দ্বিতীয় দিন হোম স্টে-তে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে যায়। ঘরে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে একটু থিতু হতে না হতেই হাঁক পাড়লেন পরিমল দা (হোম স্টে-র মালিক)। জানালেন, ধোঁয়া ওঠা লিকার চা সহযোগে গরম গরম চিকেন পকোড়া রেডি। দেরি না করে সবাই হামলে পড়লাম ডাইনিং হলে। সুস্বাদু আহার চর্বনের মজা দ্বিগুন হল পরিমল দার সঙ্গে গল্প জমিয়ে।
জানলাম, মুখে কাচা-পাকা দাড়ি, ছিপছিপে চেহারার ওই ব্যক্তির আদি বাড়ি সোদপুরে। আমাদেরই মতো ঘুরতে এসে ভালো লেগে যায় ডুয়ার্স। ভালোলাগা ছিল এতটাই যে মূর্তি নদীর ধারে কিনে ফেলেন বেশ খানিকটা জায়গা। তৈরি করে ফেলেন দু-কামরার ঘর। নিজের পদবি অনুযায়ী নাম দেন রাহুতবাটি। কিছুদিন যেতে না যেতে ওই বাড়িকেই সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে ফেলেন হোম স্টে। সখ করে নাম রাখেন ডুয়ার্স নেস্ট। যা ওই এলাকার প্রথম হোম স্টে বলে জানালেন পরিমল রাহুত। এখন সেখানে বহু পর্যটকদের আনাগোনা।
কথা বলতে বলতে কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে টের পাইনি। ঠিক তখনই আমাদের গাড়ির চালক স্বপন এসে হাজির হলেন। জানালেন, সকালের ডেস্টিনেশন জলদাপাড়া অভয়ারণ্য। আচার সহযোগে পরোটা ও দেশি মুরগির ঝোল উদরস্থ করে নিদ্রা গেলাম। এক ঘুমে রাত কাবার।
জলদাপাড়া অভয়ারণ্য
ব্রেক ফার্স্ট ও লাঞ্চ গাড়িতে তুলে সকাল আটটায় 'চলো লেটস গো'। আঁকাবাঁকা চা বাগান ও রাবার গাছের কোল বেয়ে বয়ে চলা রাস্তায় সঙ্গী হলো পরশপাথরের ইচ্ছেডানা, ক্যাকটাসের হলুদ পাখি। সলিল চৌধুরী, আরডি বর্মনরাও দিলেন উঁকি-ঝুঁকি।
মূর্তি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে পৌঁছতে সময় লাগলো পাক্কা দেড় ঘণ্টা। সেখানে প্রবেশের জন্য টিকিটের কাউন্টার খোলে সকাল দশটায়। আমরা পৌঁছনোর আগেই সেখানে লাইন পড়ে যায় বিস্তর। সে যাত্রায় চালক স্বপন আমাদের পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সোর্স খাটিয়ে তিনি জোগাড় করে আনলেন টিকিট।
ছোটবেলায় ভূগোলে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের নাম বহুবার শুনলেও তা ছিল শিশু পাঠ্যে মুখ ঢেকে থাকারই সমান। কিন্তু বাস্তবে যা দেখলাম তা আমার কল্প-ভাবনার থেকেও সুন্দর, বন্য এবং ঐকান্তিক। ২১৬ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত জলদাপাড়া জঙ্গলের সিংহভাগ অংশীদারী বকলমে এক শৃঙ্গী গণ্ডারদের দখলেই রয়েছে। বাকী অংশের পাহারায় গজপতিদের দল। ভূটান পাহাড়ের পাদদেশে এবং তোর্সা নদীর গতিপথের অববাহিকায় জলদাপাড়ার অবস্থান হওয়ায় এই জঙ্গল হাতি ও গণ্ডারদের অন্যতম প্রিয় বলে জানালেন সেখানকার গাইড। কাঁটা-ঝোপ, গাছ-গাছালিতে ভরা মেঠো পথ ধরে ওই অভায়ারণ্যের মূল আকর্ষণ হলং বাংলোয় পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগলো না।
বিরাট ওই কাঠের বাংলোর সম্মুখ ভাগে রয়েছে এক মস্ত জলাশয়। তাকে ঘিরে থাকা দিগন্ত বিস্তৃত বনানী যেন বাহুল্যবর্জিত কোলাহলহীন কোনও ভিন গ্রহ। যেখানে রণক্লান্ত শহুরে হৃদয়ে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে লাল-নীল বিহঙ্গরা। আশ্চর্য নীরবতা ভেদ করা মত্ত দাদুরি ও ঝিঝির তান সময়ের বেড়াজালও ছিন্ন করে।
হলং বাংলোর সামনের জলাশয়ের এক প্রান্তে নুন খেতে আসে বন্যপ্রাণীরা। সেখানেই বর্ষার আগে পেখম তুলে ময়ূরের নাচ দেখার দৃশ্যও নাকি বড়ই মনোরম। শাল, শিশু, খয়েরের ঘন জঙ্গল এবং তারই সঙ্গে ফলঙ্গি ও হলং নদীর ধীর গতিপথ পর্যটকদের মুগ্ধ করে। হাতির পিঠে চেপে আরণ্যক প্রাণী দর্শন জলদাপাড়ার মূল আকর্ষণ বলা চলে। মোট তিনটি হাতিতে সওয়ার হলাম আমরাও। দেখলাম বন্যপ্রাণীদের ঘর সংসার। শিখলাম নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা।
বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটাতে রাজ্য সরকারের ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সাইটে গিয়ে হলং বাংলো বুক করা যায় আনায়াসে। তবে চাহিদা অত্যধিক হওয়ায় তা আগেভাগে বুকিং করাই শ্রেয়।
টোটো পাড়া
জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের গেট খোলে দুপুর তিনটেয়। সকাল দশটা থেকে অতক্ষণ মাছি ও মশা তাড়ানোর জন্য বসে না থেকে স্বপনের পরামর্শে আমরা টুক করে নিকটস্থ সাউথ খয়েড়বাড়ি নেচার পার্ক থেকে ঘুরে এসেছিলাম। মাদারিহাট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ওই পার্কে যাওয়ার পথে চোখে পড়ে বুড়ি তোর্সা নদী।
পথিমধ্যে এক স্থানে পরপর গাছ ও কাঠের গুড়িতে ভর করে মাটি থেকে নিরাপদ উচ্চতায় খড়-বিচুলি, নারকেল পাতা দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখে অবাক হলাম। চালক স্বপন জানালেন, এলাকার নাম টোটো পাড়া। মত্ত হাতির পাল এবং মাংস লোলুপ চিতা-হায়নার হানা থেকে সন্তানদের বাঁচতে মাটি থেকে কিছুটা উপরে ঘর বাঁধেন টোটো সম্প্রদায়ের মানুষ। বন্যপ্রাণী ও মানবজাতির এমন ঐকান্তিক সহাবস্থান দেখে মনে হয়, এ যেন অচেনা এক দেশ।
সাউথ খয়েরবাড়ি নেচার পার্ক
কিছু পরেই সাউথ খয়েড়বাড়ি নেচার পার্কে পৌঁছল আমাদের গাড়ি। মূলত বাঘ ও চিতাবাঘের চিকিসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে এই নেচার পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে প্রকৃতির বুকে জীব-জন্তুদের অবাধ বিচরণ দেখতে যেন সুদীর্ঘ লোহার খাঁচায় আটকা থাকেন পর্যটকরাই। ব্যাটারিচালিত গাড়ি করে পার্ক ঘোরার মজাই আলাদা। ভিতরে রয়েছে পিকনিক স্পট। তারই অদূরে জলাশয়ে বোটিংও করেন অনেকে।
সেখান থেকে জলদাপাড়া ফেরার পথে এক রাবারের বাগানে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলেন স্বপন। গাছ থেকে চুয়ে পড়া রাবারের কষ ধরে রাখার জন্য নিচে বেঁধে রাখা হয়েছে বাটি। সেও এক অপূর্ব মাধুর্যে ভরা পরিবেশ। সেখানেই লাঞ্চও সেরে নিয়েছিলাম আমরা।
সেদিন সন্ধ্যায় যখন হোম স্টে-তে ফিরেছিলাম, তখন চোখ মুখে ভর করেছিল আলাদা তৃপ্তি। ধীরে ধীরে আঁধার আরও নিবিড় হল। ঘন হল সৌন্দর্য্য। এক পেয়ালা চা নিয়ে ঘরে বসে নীরবতা পালনের সময় আচমকাই ভেসে এল বাঁশির সুর। চাঁদনি রাতে দূরে মূর্তি নদীর ধারে কে যেন পাহাড়িয়া ধুন তুলেছে। সেই সুরে পাগল হয়ে সেদিকেই ছুটে চললাম আমরা। পিছু নিলেন পরিমল দা-ও। গ্রাম্য ওই শিল্পীও বড় মিশুকে। নিমেষে গাঢ় হল আত্মীয়তা। চলল গান, গল্প, কবিতা পাঠ। রাতের খাবার সেখানেই আনালেন পরিমল দা। মূর্তি নদীর ধারে পাথর শয্যায় কাটল অর্ধেক রজনী।
(দ্বিতীয় কিস্তি)
[আরও পড়ুন:গহীন অরণ্যের মাঝে, ডুয়ার্সের জঙ্গলে কয়েকদিন]