সিঙ্গুরের পথ ধরে ভাঙড় আন্দোলন কি পারবে মমতার ভিত নড়িয়ে দিতে, প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়
মাত্র সাত বছরেই যে রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো আরও একটি আন্দোলনের পথ খুলে যাবে তা ভাবতে পারেননি স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। এই দুই আন্দোলনকে পাথেয় করেই রাজ্যে পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করেছিল বর্তমান শাসক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ্য নেতৃত্বে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের আন্দোলন যে গতি পেয়েছিল তাতে কার্যত উড়ে গিয়েছিল ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথর বামফ্রন্ট সরকার।
তারপর বাংলার বুকে পরিবর্তনের সৌজন্যে মা-মাটি-মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মাত্র সাত বছরেই যে রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো আরও একটি আন্দোলনের পথ খুলে যাবে তা ভাবতে পারেননি স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের পর ভাঙড়ে আরও একটি জমি আন্দোলন শুরু হয়েছে। তবে কি ভাঙড় আন্দোলনে ভর করে মমতা সরকারের ভিত নড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে? সেটাই এখ লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৃণমূলের দ্বিতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পরই ভাঙড় আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। ঠিক যখন সুপ্রিম কোর্টে ঐতিহাসিক রায়ের ফলে সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক বিজয়োৎসব মেতে উঠেছিল রাজ্যের সরকার, ঠিক তখনই সিঙ্গুর রায়কে অবলম্বন করেই রাজ্যে কয়েকটি জমি আন্দোলন শুরু হয়েছিল।
[আরও পড়ুন:কলেজে 'নগ্ন' করে নিগ্রহ! 'দ্বিমত' প্রাক্তন ও বর্তমান টিএমসিপি সভাপতির]
শিল্পায়নের লক্ষ্যে সিঙ্গুরে বামেরা জমি অধিগ্রহণ করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অধিগৃহীত ৯৯৭ একরের সিংহভাগই ফিরিয়ে দিয়েছেন কৃষকদের। তারপরই রাজারহাটে উপনগরী গড়ে তোলার জন্য অধিগৃহীত ৬ হাজার ৮৩৯ একর জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে। বর্ধমানের উপকণ্ঠ উপনগরী, শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে উপনগরী, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরেও অধিগৃহীত জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে। একই দাবি ওঠে বীরভূমের বোলপুরেও। আর এই তালিকায় সর্বশেষ সংয়োজন ভাঙড়।
সবকটি আন্দোলনই প্রায় স্তিমিত। কিন্তু ভাঙড়ের জমিতে পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলন প্রায়ই জমাট বাঁধছে। বলা যায়, ধিকিধিকি জ্বলছে এই আগুন। একটু ধুনো দিলেই জ্বলে উঠছে আগুন। বিগত দু-বছর ধরে এই আন্দোলন সমানে চলছে। দুই ছাত্রের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তারপর অবশ্য ২০১৭ সালে স্তিমিত হয় আন্দোলন। তবে তা ফের জ্বলে ওঠে পঞ্চায়েত ভোটের আগে। ফের এক খুনে প্রাণ ফিরে পায় আন্দোলন।
পঞ্চায়েত ভোট শেষ হলেও সেই আগুন কিন্তু নেভেনি। এবার পঞ্চায়েত ভোটে লড়াই করে জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি। জয় পান তাঁরা। তারপর যখন মনে হচ্ছিল অন্তত বাইরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অচলাবস্থা আপাতত থমকে যাবে, কিন্তু তা হল না। বরং, উল্টে ভাঙড় আন্দোলনের প্রধান মুখ সিপিআইএমএল রেডস্টার নেতা অলীক চক্রবর্তীর গ্রেফতারে ফের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে উঠল ভাঙড় আন্দোলন।
এই আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছে বামেরা। মূলত বামেরাই এই আন্দোলনকে চালিত করছে। বাইরে সিপিআইএমএল রেডস্টার নেতাদের দেখা গেলেও, নেপথ্যে সুজন চক্রবর্তীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিষ্কার করে বলতে গেলে সিপিএমই ভিতর থেকে পরিচালিত করছে এই আন্দোলন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম যেমন মাওবাদীরা ঢুকে পড়েছিল, এখানেও তেমনই মাওবাদী ইন্ধন রয়েছে বলে শাসকদল অভিযোগ করে আসছে।
তবু বলা যায়, নেপথ্যে সিপিএম-সহ বামনেতৃত্ব রয়েছে। আর বাইরে বামপন্থী আর এক দল সিপিআইএমএলকে দেখা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যেমন- আমরা আক্রান্ত, সেভ দ্য ডেমোক্রেসি-সহ একাধিক সংগঠন নেমে পড়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে এই আন্দোলনকে আরও বড় রূপ দেওয়ার।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলবদল নিয়ে বিরোধী হিসেবে যে ভূমিকা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, বর্তমান বিরোধী নেতৃত্ব সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছেন না ভাঙড় আন্দোলনকে। সিঙ্গুরে যেমন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ফলে জায়গা পেয়ে গিয়েছিল বিরোধীরা। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছেন না।
এখনও পরিষ্কার নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত ভাঙড় আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে ভুল পথে পদচারণা কি না। যেমন- ভাঙড় আন্দোলনের মুখ অলীক চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করে কঠোরতা দেখিয়েছেন মমতা। মমতা প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত সমীচিন কি না, তা জানা যাবে ভবিষ্যতে।
একাংশ মনে করছেন, অলীক চক্রবর্তীকে গ্রেফতার করে আন্দোলনের কোমর ভেঙে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য একটা পক্ষ মনে করছে এর ফলে ভাঙড়ের আন্দোলনকারীরা আরও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যাবে। এই আন্দোলন আরও বড় রূপ পাবে। তবে সেটা বলবে ভবিষ্যৎ।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা প্রযোজ্য যে, সুজন চক্রবর্তীরা এই আন্দোলনকে সিঙ্গুরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি। বর্তমান বিরোধী দল সিপিএম-কংগ্রেস পারেনি ভাঙড় আন্দোলনকে চরম রূপ দিতে। পারেনি বিজেপিও। ফলে ভাঙড় আন্দোলনের সিঙ্গুর-রূপ পাওয়া দুরুহ বর্তমান রাজনীতিতে।