বাইরে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি, আমার চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা
ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার শ্রেয়সী রায় আদতে কলকাতার মেয়ে। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় 'ফাইলিন' যখন আছড়ে পড়েছিল ওডিশা উপকূলে, তার কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতার বিমান ধরেছিলেন তিনি। বিমানে বসেই অনুভব করেছিলেন দুর্যোগ। হাড়হিম করা সেই কাহিনী তিনি শোনালেন 'ওয়ানইন্ডিয়া বাংলা'-কে)
ছুটি নিয়ে দু'বছর পর বাড়ি যাচ্ছিলাম। আনন্দই আলাদা। রওনা হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে জমিয়ে প্ল্যান করছিলাম, কলকাতায় গিয়ে কী কী করব, কোন কোন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেব, কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাব এই সব। আমার ফ্লাইট ছিল সকাল এগারোটা দশে। যথা সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে। বিমানে ওঠার আগে বাড়িতে বাবাকে ফোন করেছিলাম। বাবা বলল, কলকাতায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ একটা ঘূর্ণিঝড় ওডিশার গোপালপুরে আছড়ে পড়বে শুনলাম। ভাবলাম, ভাগ্যিস বিকেলের ফ্লাইটে টিকিট কাটিনি। নির্ঘাৎ ফ্লাইট বাতিল হত আর আমাকে মুখ গোমড়া করে ব্যাঙ্গালোরের আস্তানায় ফিরে আসতে হত।
বিমান ঠিক সময়ই ছেড়েছিল। জানলার ধারে সিট পেয়েছিলাম। বিমানে চাপলে জানলার ধারে বসি। দারুণ লাগে। বিমান যত ওপরে ওঠে, মানুষগুলো খুদে খুদে দেখায়। নদী দেখায় সরু ফিতের মতো। আর গোল পৃথিবীর দিগন্তরেখা দেখতে দারুণ লাগে। জানলার ধারে বসে ট্যাব দিয়ে ছবি তুলছিলাম। আড়াই ঘণ্টার ফ্লাইট। প্রথম এক ঘণ্টা বেশ কাটল। একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে আবার জানলা দিয়ে পটাপট ছবি তুলতে লাগলাম।
আরও
পড়ুন:
হুড়হুড়িয়ে
আসছে
'হুদহুদ',
ঘনাচ্ছে
দুর্যোগের
শঙ্কা
আরও
পড়ুন:
১৫৫
কিলোমিটার
বেগে
আঘাত
করবে
'হুদহুদ',
দাবি
হাওয়া
অফিসের
আরও
পড়ুন:
এক
নজরে
'ঝোড়ো'
পরিভাষা
হঠাৎ দেখি জানলার বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। সাদা সাদা মেঘের কুণ্ডলী। বিমানের ভিতরে ক্রমশ আলো কমে আসছে। বুঝতে পারছি, মেঘের ভিতর ঢুকেছে আমাদের প্লেন। তখনও কী অপেক্ষা করে আছে বুঝতে পারিনি!
আচমকা থরথর করে কাঁপুনি! গোটা বিমানটাই কাঁপছে। এ কী রে বাবা! আগে কতবার প্লেনে চড়েছি, এমন তো কখনও হয়নি। তখন ছবি তোলা মাথায় উঠেছে। হঠাৎ মনে হল, বিমান শোঁ করে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আবার থরথর করে কাঁপুনি। এতটা জোরে যে, সিটের ওপর যে ওভারহেড বিন থাকে, সেটা খুলে গিয়ে একটা পেল্লাই সাইজের ব্যাগ এক মহিলার মাথায় দড়াম করে পড়ল। তিনি তো হাঁইমাই চিৎকার শুরু করে দিলেন। হঠাৎ আর একটা ঝাঁকুনি। এ বার বুঝলাম, আবার বিমান উঠে আসছে ওপরের দিকে। সামনের দিকের সিটে থাকা এক দম্পতির কোলে বছর দুয়েকের সন্তান ছিল। সে তো মাকে আঁকড়ে ধরে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল। এয়ার হস্টেসরা চিৎকার করছে, শক্ত করে সিটবেল্ট বেঁধে নিন। কেউ জায়গা ছেড়ে নড়বেন না।
"বুঝি আস্ত বিমানটা ছাই হয়ে যাবে। ঈশ্বরকে ডাকছি আর বলছি, যেন ঠিকঠাক পৌঁছতে পারি"
কিন্তু হচ্ছেটা কী? এ সময় অ্যানাউন্সমেন্ট সিস্টেমে ভেসে এল পাইলটের গলা। এক গম্ভীর পুরুষকণ্ঠ বলল, "ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। ভয় পাবেন না। ওডিশায় এখন দুর্যোগ চলছে। ঝড় আসছে। আমরা শক্তিশালী এয়ার পকেটে পড়েছি। তাই একটু অসুবিধা হচ্ছে। আমরা বেরিয়ে যাব।"
পাইলট তো বলেই খালাস! কিন্তু যাত্রীদের অবস্থা ভাবুন। ৩৫ হাজার ফুট ওপরে ভাসছে সবাই। চারদিকে দুর্যোগের মেঘ। নীচ থেকে যে মেঘ দেখতে কালো লাগে, সেই মেঘের ওপরে উঠলে শুধু সাদা সাদা রং। সে যাই হোক, দুর্যোগের মেঘ তো! এ সব ভেবে গলা শুকিয়ে কাঠ। হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি। সাদা মেঘের পেট চিরে ফেটে বেরোচ্ছে তীব্র আলো। বুঝলাম বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিমানের ভিতরে বাজের শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু যা আলো ঝলকাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি আস্ত বিমানটা ছাই হয়ে যাবে। ঈশ্বরকে ডাকছি আর বলছি, যেন ঠিকঠাক পৌঁছতে পারি কলকাতায়।
যত ভাবছি, মাথায় ভিতরে একটা চিনচিনে যন্ত্রণা অনুভব করছি। মনোযোগ ঘোরাতে কানে হেডফোন খুঁজে মোবাইলে গান শুনতে লাগলাম। অন্য সময় হলে গানগুলো উপভোগ করতাম। কিন্তু তখন গানের ভাষা দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে হেডফোনটা খুলে রেখে দিই।
বাকি দেড় ঘণ্টা যেন দেড়শো বছর মনে হচ্ছিল। অকস্মাৎ একটা ঝাঁকুনি আর ঘরঘর শব্দ। সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠে ঘোষণা, 'ওয়েলকাম টু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কলকাতা'!
বলে কী! কলকাতা এসে গিয়েছি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রানওয়েতে নেমে বিমান তখনও ছুটে চলেছে। জানলার কাঁচ দিয়ে অঝোরে নামছে জলের ধারা। বুঝলাম বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে কলকাতা।
আস্তে আস্তে বিমান থামল। খুলে গেল দরজা। ব্যাগ হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে ঠান্ডা বাতাসের হলকা এসে লাগল চোখে-মুখে। সত্যিই পুনর্জন্ম হল! বুঝলাম জীবন কতটা মূল্যবান! পরিস্থিতি ভেদে তা বোঝা যায়। বাইরে তখনও অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। আর আমার চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। আনন্দে।