আন্দোলনের পাহাড়ে বেহাল শিক্ষায় ‘রিফিউজি’ ছাত্রছাত্রীরা, ক্লাস হচ্ছে ম্যারেজ হলে
পাহাড়়ে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ এখন ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা বোর্ড-পরীক্ষার প্রস্তুতি সারতে পারছে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিকল্প ব্যবস্থা করেছে।
অশান্ত পাহাড়ে মোর্চার হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের জেরে 'রিফিউজি' অবস্থা পাহাড়ের নামী স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের। মোটা টাকার বিনিময়ে ম্যারেজ হল বা কমিউনিটি হল ভাড়া করে পঠন-পাঠন চালাতে হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। আবার কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন জেলা স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বিকল্প পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাহাড়়ে ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ এখন ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা বোর্ড-পরীক্ষার প্রস্তুতি সারতে পারছে না। তাঁদের এই অসহায় অবস্থায় স্কুল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে এসেছে। সমতলের স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থার পাশাপাশি হল ভাড়া করেও পঠন-পাঠন চালানো হচ্ছে। তবু বই-খাতা-নোট স্কুল ও হস্টেলে পড়ে থাকায় অনেক ছাত্রছাত্রীই ঘোর সংকটে।
অন্যান্য শ্রেণির পড়ুয়াদেরও পঠনপাঠনে শিকেয় উঠতে বসেছে পাহাড়ের অনির্দিষ্টকালীন বনধের জেরে। গ্রীষ্মের ছুটি বাড়িয়ে দেওয়া হলেও, স্কুলের অভাব বোধ করছে তাঁরাও। এমতাবস্থায় বিকল্প ব্যবস্থা করতে হন্যে হতে হচ্ছে সমস্ত পড়ুয়াদেরই। শুরু হয়ে গিয়েছে টাকার খেলা। মোটা টাকার বিনিময়ে রিফিউজির মতো স্কুল করতে হচ্ছে তাদেরও।
গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে মোর্চার আন্দোলনে পাহাড় তথা দার্জিলিংয়ের স্বাভাবিক জীবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। তিনমাস হতে চলল পাহাড়ে অনির্দিষ্টকালীন বনধ চলছে। তারই ভয়ানক প্রভাব পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। বিদ্যালয় ভবনের পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, হস্টেল থাকা সত্ত্বেও নাজেহাল অবস্থা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার পড়ুয়াদের। নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকেও। পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, পঠনপাঠন শুরু করতে না পারলে ঘোর বিপদ! কী করবে ছাত্রছাত্রীরা, সেই ভাবনাতেই ক্ষোভ বাড়ছে শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক-অভিভাবিকাদের।
দশম শ্রেণির ছাত্রী রাজশ্রী চন্দ পড়াশোনা করে কার্শিয়াংয়ের হিমাদ্রি বোর্ডিং স্কুলে। পাহাড়ে আন্দোলনের জেরে স্কুল বন্ধ। তাই শিলিগুড়ির একটি ম্যারেজ হলে ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে। স্কুল থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে এই পঠনপাঠনের ব্যবস্থা। স্কুলের হস্টেলে রয়ে গিয়েছে বহু বই, খাতা ও নানা শিক্ষা-সামগ্রী। তা আনতে পারেনি সে, অসুবিধা নিয়েই রাজশ্রী তৈরি হচ্ছে বোর্ড পরীক্ষার জন্য।
হিমাদ্রি বোর্ডিং স্কুলের অধ্যক্ষ রবীন্দ্র সুব্বা জানান, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ২৩০ জন পড়ুয়াকে শিলিগুড়িতে এনে একটি ম্যারেজ হল ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী স্কুল করা হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ হাজার টাকা করে ভাড়া গুণতে হচ্ছে এ জন্য। ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁদের এই ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে। কেননা ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল খারাপ হলে তাদের ভবিষ্যতে যেমন প্রভাব পড়বে, অভিভাবকরাও তাঁদের ছেড়ে কথা বলবেন না।
রাজশ্রীর মতোই কেভিন সাগরও জানাল তাঁর সমস্যার কথা। কেভিন এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সেন্ট জোসেফের এই ছাত্রের কথায়, 'আমি ঝাড়খণ্ড থেকে এখানে এসেছি পড়াশোনা করতে। আমার কাছে বিকল্প কোনও উপায় নেই। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে পড়ে থাকতে হচ্ছে। শিলিগুড়ির কাছে মাটিগাড়ায় অস্থায়ী স্কুলে ক্লাস করছে সে।
নর্থ পয়েন্ট সেন্ট জোসেফের রেক্টর সাজুমান সিকে জানান, ২২০ জন ছাত্রের পড়াশোনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের কাছেও অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমরা আশা করেছিলাম পাহাড় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে আশার কোনও আলো মিলছে না। বাধ্য হয়েই বিকল্প ব্যবস্থা।
রাজশ্রী ও কেভিনের মতো ১২টি স্কুলের প্রায় চার হাজার পড়ুয়াকে শিলিগুড়িতে নিয়ে গিয়ে পঠনপাঠনের ব্যাবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। পাহাড়ের ৫২টি স্কুল ইন্ডিয়ান স্কুল সার্টিফিকেট এক্সামিনেশন কাফউন্সিল অনুমোদিত। এর মধ্যে ৪০টি স্কুলে বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
এই স্কুলগুলিতে অনেক বিদেশি ছাত্রছাত্রীও রয়েছে। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, কোরিয়া কানাডা, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশের পড়ুয়ারা পাহাড়ে এসে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় পড়তে আসে। এছাড়া আটটি কলেজে অন্তত ৬ হাজার ছাত্রছাত্রীও রয়েছে।
শুধু শিলিগুড়িতেই নয়, দার্জিলিংযের বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়াদের এনে রাখা হয়েছে কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন অন্যান্য জেলার স্কুল হস্টেলেও। দার্জিলিংয়ের মাউন্ট হরমান স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে কলকাতা গার্লস স্কুল ও কলকাতা বয়েজ স্কুলে। ডে স্কলার-এর ক্লাসের ব্যবস্থা হয়েছে হুগলির ডানকুনিতে।
অশান্ত পাহাড়ে শিক্ষার এই হাল প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, 'দার্জিলিং বিখ্যাত তিন 'টি'-র জন্য। টি অর্থায চা, টুরিজম অর্থাৎ পর্যটন আর টিচিং অর্থাৎ শিক্ষা। কিন্তু মোর্চার হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের জেরে সেই তিন টি-ই বিদায় নিয়েছে। দার্জিলিং বোর্ডিং স্কুলের জন্য বিখ্যাত। আন্তর্জাতিক সুখ্যাতিও রয়েছে দার্জিলিংয়ের। তা না ভেবেই পাহাড়ের অর্থনীতিকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে।'