গান-পয়েন্টে শিক্ষকের দল, দুষ্কৃতী তাণ্ডবে তোলপাড় গয়েশপুর, এসপি-কে চিঠি আক্রান্ত আমরা-র
স্কুলে-র মধ্যে দুষ্কৃতী তাণ্ডবের অভিযোগ। গান পয়েন্টে রেখে শিক্ষকদের মারধর করা থেকে শুরু শিক্ষিকাদের শ্লীলতাহানি- বাদ যায়নি কিছু।
স্কুলে-র মধ্যে দুষ্কৃতী তাণ্ডবের অভিযোগ। গান পয়েন্টে রেখে শিক্ষকদের মারধর করা থেকে শুরু শিক্ষিকাদের শ্লীলতাহানি- বাদ যায়নি কিছু। এমনই অভিযোগ করা হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে আতঙ্কে কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা মুখ খুলতেই চাইছেন না। কেউ নিজের নাম পর্যন্ত বলতে ভয় পাচ্ছেন। এই ঘটনা কল্যাণীর গয়েশপুরের গোকুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যদিও, পুলিশ ইতিমধ্যেই এক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে।
এই ঘটনায় ২০ ডিসেম্বর আক্রান্ত আমরার পক্ষে যুগ্ম আহ্বায়ক অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং অরুণাভ গঙ্গোপাধ্য়ায় নদিয়ার পুলিশ সুপারকে একটি চিঠি দিয়েছেন। এমন ঘটনায় শিক্ষকরা কতটা আতঙ্কে আছেন তাও জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে। অবিলম্বে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারির দাবিও জানিয়েছে আক্রান্ত আমরা।
জানা গিয়েছে, ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে গোকুলপুর প্রাথমিক বিদ্য়ালয়ে ছুটির পর ৮টি স্কুলের জনা পঁচিশ শিক্ষক-শিক্ষিকা একটি বৈঠক করছিলেন। বেতন বৈষম্য নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকারা উস্থি ইউনাইটেড প্রাথমিক শিক্ষক ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন-এর ব্য়ানারের তলায় আন্দোলন করছেন। সেই আন্দোলনের আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার জন্য এই শিক্ষকরা জড়ো হয়েছিলেন। সেই নিয়েই আলোচনা শুরু হতে না হতেই নাকি স্কুলের ভিতরে ঢুকে পড়ে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা। আক্রান্ত আমরার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিকেল ৪টা নাগাদ একটি গাড়ি গোকুলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এসে থেমেছিল। সেই গাড়ি থেকে বেশকিছু সশস্ত্র লোক নেমে আসে। যাদের হাতে বাঁশ ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। স্কুলের সামনেই থাকা শিক্ষকদের মোটর বাইকগুলি তারা ভাঙচুর করতে করতে ভিতরে ডুকে পড়ে বলে অভিযোগ। শিক্ষক-শিক্ষিকারা যে ঘরে বৈঠক করছিলেন সেই ঘরে ঢুকে সশস্ত্র এই দুষ্কৃতীর দল ঢুকে পড়ে বলেও অভিযোগ। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মারধর করা হয়। বেশকিছু শিক্ষকের কপালে আগ্নেয়াস্ত্রও ঠেকিয়ে ধরা হয় বলে অভিযোগ। কয়েক জন শিক্ষক এর প্রতিবাদ করতেই তাঁদের সেখান থেকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ। গাড়িতে তুলে এই চার শিক্ষককে বেধড়ক মারধরও করার অভিযোগ সামনে এসেছে। স্কুল থেকে প্রায় কিলোমিটার দুয়েক দূরে নিয়ে গিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়ে-তে ফেলে দেওয়ার অভিযোগও সামনে এসেছে। পরে পুলিশ এদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা হওয়ার পর কল্যাণী থানাতেও নিয়ে আসা হয়েছিল প্রহৃত শিক্ষকদের। নিগৃহীত সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বয়ানও পুলিশ শোনে। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা এতটাই আতঙ্কগ্রস্থ যে এই বিষয়ে কেউ টু-শব্দটি করতে চাইছেন না। তবে, স্থানীয় এক বিশ্বস্ত সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। যিনি একজন কাউন্সিলর। তাঁর নেতৃত্বেই এই হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশ-ও সে কথা জানে। কিন্তু, সেই তৃণমূল কাউন্সিলরের এতটাই দাপট যে পুলিশও তাঁকে ঘাটাতে ভয় পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যা খবর তাতে এই ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। নিগৃহীত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তরফে একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে তাঁরা কোনওভাবেই অভিযোগ দায়ের করেননি। পুলিশ অভিযোগ দায়েরের সত্যতা স্বীকার করলেও এটা সুয়োমোটো না অন্য কেউ এফআইআর করেছে- তা নিয়ে কিছু খোলসা করেনি।
এদিকে, এই ঘটনার পরের দিনই ১৬ ডিসেম্বর কলকাতায় একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিল উস্থি ইউনাইটেড প্রাথমিক শিক্ষক ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন। কলেজ স্ট্রিট থেকে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার পর্যন্ত মিছিলও হয়। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিয়ে লড়াই করা এই সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক পৃথ্বা বিশ্বাস, গোটা ঘটনার নিন্দা করেছেন। তাঁর অভিযোগ, শিক্ষকরা এখন আতঙ্কে রয়েছেন। ঘটনার পিছনে থাকা দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতার দাবি করেছেন তিনি। সেইসঙ্গে প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকার সুরক্ষাও দাবি করেছেন। কল্যাণীর এসডিপিও-র দফতরেও একটি স্মারক লিপি জমা দিয়েছে উস্থি ইউনাইটেড প্রাথমিক শিক্ষক ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন। শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের রাজ্য় সম্পাদক মইদুল ইসলামও এই ঘটনার প্রতিবাদে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এই হামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশ কোনও গতিপ্রকৃতি জানাতে রাজি হয়নি। তবে, হামলার পিছনে শাসক দলের আক্রোশের কারণকে শিক্ষা মহলের অনেকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বেতন বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন রাজ্য জুড়েই ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে নব্বই শতাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা-ই উস্থি ইউনাইটেড প্রাথমিক শিক্ষক ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন-এর ব্যানারের নিচে এই বেতন বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই পরিস্থিতে নজরুল মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পাল্টা একটি সম্মেলন করা হয়েছিল। যেখানে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ও উপস্থিত ছিলেন। এটা শিক্ষকদের সম্মেলন হলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় সেখানে অংশ নেওয়া অধিকাংশই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গেই যুক্ত নন। কেউ গাড়ি চালান, কারোর আবার সরকারি চাকরিও নেই। এমনকী, বিকাশ ভবনের এক শিক্ষক বন্ধুকেও সেই সম্মেলনে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। অভিযোগ, তৃণমূলের এই সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে বোঝার পর থেকেই উস্থি ইউনাইটেড প্রাথমিক শিক্ষক ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন-এর ব্য়ানারের নিচে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরে এলাকায় এলাকায় হামলা শুরু হয়েছে। তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি-র দিকেও এই নিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের শিক্ষক সংগঠনের রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র-এর বিরুদ্ধে বর্ধমান পূর্ব-এর শিক্ষিকাদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ সামনে এসেছে। উত্তর ২৪ পরগনাতেও নিজেকে দোর্দন্ডপ্রতাপ বলে দাবি করা এক তৃণমূল শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধেও সরকারি মঞ্চ ব্যবহার করে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শাসানোর ভিডিও সামনে এসেছে। বাম আমলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের যেভাবে সংকীর্ণ রাজনীতির শিকার করা হত তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে তা মাত্রা ছাড়া জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে বলেও বহু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভিযোগ।