বিমল গুরুং-এর ডেরায় পুলিশি 'এনকাউন্টার', দেখুন অভিযানের এক্সক্লুসিভ ভিডিও
হাতের নাগালে এসেও ফের ফসকে গিয়েছে বিমল গুরুং। শুক্রবার ভোররাতে হওয়া পুলিশি অভিযানে গুরুং দার্জিলিং-এর কাছে রাম্মাম নদী পেরিয়ে সিকিমে পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় এক পুলিস অফিসারেরও মৃত্যু হয়।
প্রায় আড়াই মাস ধরে রাম্মাম নদীর তিরে ঘাঁটি গেড়েছিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং। অথচ পুলিশ প্রশাসনের কাছে কোনও খবরই ছিল না। যদিও, বিশ্বস্ত সূত্রে দাবি করা হচ্ছে দার্জিলিং-কে বেস্টন করে এমন আরও চার থেকে পাঁচটি ডেরা রয়েছে বিমল গুরুং-এর। এর মধ্যে কয়েকটি ডেরা আবার পশ্চিমবঙ্গের সীমানা লাগোয়া সিকিমে। কোনও ডেরাতেই তিন-চারদিনের বেশি থাকত না বিমল গুরুং। সম্প্রতি বিমল গুরুং একটি ভিডিও বার্তায় জানিয়েছিল যে ৩০ অক্টোবর সে প্রকাশ্যে আসবে। পুলিশ সূত্রে দাবি, এই ডেরা থেকেই সেই ভিডিও বার্তা গিয়েছিল।
জোড়থাং পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় বিমল গুরুং-এর যে গতিবিধি বাড়ছে তার খবর পুলিশের কাছে ছিল। কিন্তু, যেহেতু মোর্চা প্রধান সমানে সিকিম আর পশ্চিমবঙ্গ করছিলেন তাই তাঁর লোকেশন ঠিক করা যাচ্ছিল না। ভিডিও বার্তা প্রকাশ্যে আসতেই শুক্রবার রাতে খবর আসে বিমল গুরুং-এর অবস্থানের। পাতলেবাসের কাছে দার্জিলিং-জোড়থাং রোডের পাশে এক পাহাড় ও জঙ্গলের এক দুর্গমস্থানে বিমল গুরুং ঘাঁটি গেড়েছে তা জানতে পারে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তিনটি দল রওনা দেয়। এই একটি দলে ছিলেন মধ্যমগ্রামের ছেলে এসআই অমিতাভ মালিক। এই তিনটি দলের পিছন পিছন যায় ব্যাক-আপ টিম। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে ব্যাক-আপ টিম অপেক্ষা করতে থাকে। আর অভিযানে নামে তিনটি সশস্ত্র বাহিনী। দার্জিলিং-জোড়থাং রোডের পাশ থেকে প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার নিচে নামতে হয় পুলিশের তিনটি দলকে। ভোররাতেই তিনটি দল পাহাড়ের ঢাল দিয়ে তিন দিক থেকে নামছিল। সূত্রের খবর, একে রাতের অন্ধকার তারমধ্যে জঙ্গল আর পাহাড়ি ঢালে যথেষ্টই অসুবিধা তৈরি হচ্ছিল।
সূত্রের দাবি, বিমল গুরুংরা আঁচ করতে পেরেছিল যে কোনও মুহূর্তে পুলিশি হানা হতে পারে। তাই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে লোকজনকে পাহারায় রেখেছিল গুরং। পুলিশ দলের পায়ের শব্দ এদের কানে যেতেই শুরু হয়ে যায় হই-হট্টগোল। নেপালি আর হিন্দিতে বিমল গুরুং-এর ঘাঁটি থেকে ভেসে আসতে থাকে আওয়াজ। সূত্রের দাবি, যেহেতু গুলি চালানো নিয়ে সরকারি কিছু নিয়ম আছে তাই শুরুতেই পুলিশ ফায়ার করতে পারেনি। পুলিশের তিনটি দলই চেষ্টা করতে থাকে যদি কোনওভাবে গুলি না চালিয়েই সকলকে অক্ষত ধরা যায়।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই বিমল গুরুংকে গার্ড করে নিয়ে পালাতে থাকে কিছু জন। পুলিশের তাড়া খেয়ে বিমল গুরুং-রা পাশের রাম্মাম নদীতে নেমে পড়ে। পুলিশের একটি দলও নেমে পড়েছিল জলে। এই দলের একদম সামনে ছিলেন অমিতাভ মালিক। এই সময়ই গুরুং বাহিনীর ছোড়া গুলি এসে সরাসরি অমিতাভ-র শরীরে লাগে। এরপরই গুরুং-এর দিক থেকে সমানে গুলি চলতে থাকে। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল ব্যাক-টিম। তাঁরাও পাল্টা গুলির জবাব দিতে থাকে। ভোরের অন্ধকারে নদীর পার হতেই হতেই বিমল গুরুংরা পাহাড়ে ৮৬ সালের মতো আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু, খরাস্রোতা নদীতে গুরুংরা পুলিশের নাগালের বাইরে চলে যায়। আর নদী পার হলেই সিকিম। যেখানে গুরুং-এর বিরুদ্ধে অভিযানে সিকিম সরকারের অনুমতি লাগবে। যদিও, ঘটনাস্থল থেকে গুরুং শিবিরের একজনকে ধরা হয়।
গুলিবিদ্ধ অমিতাভ মালিক এবং আহত অন্যান্য পুলিশকর্মীদের হাসপাতালে পাঠানোর প্রক্রিয়া শেষ হতেই শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। গুরুং-এর ঘাঁটিতে ঢুকে পুলিশবাহিনীর চোখ থ হয়ে যায়। কারণ, পাহাড়ের ধাপে দুটো কাঠের ঘর বানিয়েছিল গুরুংরা। এই দুই ঘরের থরে থরে মজুত করা একে ৪৭ রাইফেল। ৯টি একে ৪৭ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার হয় অসংখ্য কার্তুজ। ২০টা জিলেটিন স্টিক। হাজারেরও বেশি ডিটোনেটর। এছাড়াও মেলে আমেরিকায় তৈরি অ্যাতাধুনিক ব্য়ারেটা ৯ এমএম পিস্তল। এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে শোফিস্টিকেটেড ফায়ার আর্মস পরিবারের সদস্য এই ব্যারেটা পিস্তল। এমন পিস্তল দেশের কোনও নিরাপত্তাবাহিনীর কাছেই নেই। এমন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা স্বাভাবিকভাবে পুলিশ প্রশাসনকে অবাক করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে গত এক দশকে এত পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলা-বারুদ উদ্ধার করা হয়েছে কি না তা পুলিশ প্রশাসনের কেউ খেয়াল করতে পারছেন না।
পাহাড়ের আন্দোলনকে আরও হিংসাত্মক করতে গুরুং যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এবং নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তার খবর আগেই ছিল। কিন্তু, তাই বলে গুরুং-যে এমন মারাত্মক সব মরণাস্ত্র দার্জিলিং-এর কাছে এনে জমা করেছে তা আন্দাজও করতে পারেনি পুলিশ। কয়েক বছর আগে অসম পুলিশ এক ম্যাটাডোর থেকে প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিল। সেই ঘটনায় কালিম্পঙের এক মোর্চা সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়। তাকে জেরা করেই জানা গিয়েছিল নাগাল্যান্ড থেকে এই সব আগ্নয়াস্ত্র দার্জিলিং-এ নিয়ে যাওয়ার কথা। শুক্রবারের ঘটনার পর পুলিশেরও ধারণা এমন আরও কিছু ঘাঁটিতে গুরুংরা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলা-বারুদ লুকিয়ে রেখেছে।
গুরুং যে ঘাঁটি বানিয়েছিল তার থেকে কিছুটা নিচেই রয়েছে রাম্মাম নদী। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে যা রঙ্গিত নাম নিয়েছে। দার্জিলিং-জোড়থাং রোডের উপর পাতলেবাসের দিক থেকে এসে তাকভর চা বাগান পেরিয়ে এসে গাড়ি থামাতে হয়েছিল পুলিশ বাহিনীকে। এই রাস্তার উপর থেকে এবার ৫ কিলোমিটার পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নামতে হয়েছিল তাঁদের। আর গুরুং-এর ঘাঁটির পাশেই সিংলা চা-বাগান। সুতরাং, লুকিয়ে থাকার পক্ষে এটা আদর্শ জায়গা। গুরুং-এর ঘাঁটির ভিতে পেপে এবং নানা ধরনের ফলের গাছও পাওয়া গিয়েছে। পুলিশের ধারনা জায়গাটা বহুদিন আগে বাসযোগ্য ছিল। কিন্তু, পরে সেখানে কেউ থাকত না। সম্প্রতি গুরুংবাহিনী এই জায়গায় থাকা ছাউনির মতো দেখতে ঘরগুলির মেরামতি করেছিল। তবে, শুক্রবার গুরুং বাহিনী যা করেছে তাতে তারপক্ষে আর সিকিমে আশ্রয় নেওয়াটা মুশকিল বলেই মনে করা হচ্ছে।