২৮৫ বছর ধরে মা এ বাড়িতে ‘একা’ আসেন, মণ্ডপে নেই লক্ষী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশ
দেবী দুর্গা আছেন, কিন্তু মণ্ডপে নেই লক্ষী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী কেউই। হুগলির শেওড়াফুলি রাজবাড়িতে সর্বমঙ্গলা রূপে আরাধ্যা দেবী দুর্গা। ২৮৫ বছর ধরে চলে আসছে এই ধারা।
দেবী দুর্গা আছেন, কিন্তু মণ্ডপে নেই লক্ষী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী কেউই। হুগলির শেওড়াফুলি রাজবাড়িতে সর্বমঙ্গলা রূপে আরাধ্যা দেবী দুর্গা। ২৮৫ বছর ধরে চলে আসছে এই ধারা। এর অন্যথা হয়নি কোনওদিনই। আজও না। মুঘল আমল থেকেই এই রাজবাড়িতে শ্রী শ্রী সর্ব্বমঙ্গলা দেবী সেবা পেয়ে আসছেন। অকাল বোধনেও তাই সপরিবারে নয়, মা আসেন 'একা'।
অষ্টধাতুর মূর্তি
স্বপ্নানুযায়ী পুকুর খননের সময় মায়ের অষ্টধাতুর মূর্তি উদ্ধার হয়েছিল। সেই থেকেই শাস্ত্রগতভাবে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠার পর দেবী সর্বমঙ্গলা রূপে পুজিত হন। রাজা বাসুদেবের পুত্র মনোহর শেওড়াফুলি রাজবাড়িতে পাকাপাকিভাবে বাস শুরু করেন। 'ক্ষত্রিয়রাজ' রাজা মনোহর রায় ১১৪১ সালের ১৫ই জ্যৈষ্ঠ (ইংরাজির ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে) শেওড়াফুলি রাজবাটীতে শ্রী শ্রী সর্ব্বমঙ্গলা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই।
পরিবারের ইতিকথা
পরিবারের অন্যতম সদস্য আশিস ঘোষ জানান, 'আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই বংশের রাজা দ্বারকানাথ বর্ধমান জেলার পাটুলি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। দ্বারকানাথের পৌত্র সহস্রাক্ষ এবং তার পৌত্র রাঘব (রাঘবেন্দ্র) দত্ত। রাঘবের দুই পুত্র, রামেশ্বর ও বাসুদেব।
পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ
সেইসময় পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায়। অগ্রজ রামেশ্বর পাটুলি ত্যাগ করে বাঁশবেড়িয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। বাসুদেব পাটুলিতে থেকে যান এবং জমিদারি তদারকি করার সুবিধার্থে শেওড়াফুলিতে অস্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন।
পুকুরে মায়ের মূর্তি
তিনি আরও জানান, এই মূর্তিটির তাৎপর্য হল মায়ের এই মূর্তিটি প্রথাগতভাবে র্নিমিত মূর্তি নয়। একদা রাজা মনোহর রায় স্বপ্নাদেশ পান যে ‘আঁটিসাড়া' নামক একটি গ্রামের পুকুরে মায়ের মূর্তিটি আছে। তিনি যেন সেখান থেকে মা কে উদ্ধার করে মায়ের ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
সর্বমঙ্গলাপল্লি নামে পরিচিতি
সেইমতো রাজাও গ্রামে উপস্থিত হন এবং পুকুর খনন করে মায়ের অষ্টধাতুর সেই মূর্তি উদ্ধার করে শাস্ত্রগতভাবে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের মন্দির সংলগ্ন এই এলাকাটি সর্ব্বমঙ্গলাপল্লী নামেই পরিচিত।
দুই ভিন্ন বংশধরের পুজো পালন
পরিবারের আরেক সদস্য বাসবী পাল জানান, 'শেওড়াফুলির রাজবাড়ির পুজো এবার ২৮৫ বছরে পা দিল। রাজা মনোহর রায়ের হাতে শুরু হওয়া এই পুজো পালা করে পরিবারের দুই ভিন্ন বংশধর আয়োজন করেন। তবে এই পুজোর কিছু আশ্চর্য দিক রয়েছে।
দশভূজা একক দেবীমূর্তি
সাধারণত আমরা একচালের প্রতিমাতে, লক্ষী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী মূর্তি দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এটি তার ব্যতিক্রম। সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের বিশেষত্ব হল মহিষমর্দিনী দশভূজা একক দেবীমূর্তি। এটি ‘কাত্যায়ণী দেবী' নামে পরিচিত। দেবীর সঙ্গে দেখা যায় না তার সন্তানদের।
প্রতিমার বিশেষত্ব
প্রতিমার আরও একটি বিশেষত্ব হল, এখানে মায়ের বাহন সিংহের বদলে ঘোড়া। কথিত আছে, বহু বছর আগে এখানে মোষ বলি হত, তারপর পাঁঠাবলিও হত। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহুদিন। শোনা যায়, সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের স্বপ্নাদেশেই পশুবলি নিষিদ্ধ এখানে। এখন ফল, চালকুমড়ো বলি হয়। তবে এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার আগে মনোহর রায়ের পিতা বাসুদেব রায় এই বাটীতে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন।
পুজো নিয়ে সিদ্ধান্ত
মন্দিরে লক্ষ্মী-জনার্দন ছাড়াও গোবিন্দহরি-রাধিকা ও বটকৃষ্ণ নারায়ণ শিলাও নিত্য পূজিত হয়। পাশাপাশি বংশ পরম্পরানুযায়ী হওয়া এই দুর্গোৎসবে রয়েছে আরও একটি বৈশিষ্ট্য। বাসুদেব রায়ের বংশধর গিরীন্দ্র চন্দ্র রায়ের একমাত্র কন্যা হলেন নিরুপমা দেবী। তিনি এই রাজবংশের পুজোকে নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেন। ভাগলপুরের চম্পানগরবাসী রাজবংশীয় ঘোষ পরিবার বিবাহসূত্রে এই বংশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, তিনিই এই পরিবারের হয়ে পুজো এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছিলেন।
পালা করে পুজো
আর সেই কারণবশতই এক বছর রায় পরিবার এবং অন্য বছর ঘোষ পরিবার পালা করে এই রাজবাটীতে দুর্গোৎসব পালন করেন। এবং এই দুর্গোৎসব চালাকালীন এক বছর অন্তর অষ্টমীর দিন শুধুমাত্র ঘোষ পরিবার এখানে কুমারী পুজো পালন করেন। দীর্ঘ ২৮৪ বছর ধরেই দুর্গোৎসবের সময় কোনওরুপ ব্যতিক্রম ছাড়াই জাঁকজমকভাবে সমস্ত নিয়ম-রীতি পালন করে শেওড়াফুলির এই রাজবাটীতে সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের পুজো উদযাপিত হয়ে আসছে।