‘মুঘলসম্রাট জাহাঙ্গীরের জায়দাদনামা’য় সম্প্রীতি-পুজো আক্ষরিক অর্থেই মহামিলনোৎসব
সিংহমজুমদার বাড়ির পুজো আজও প্রচলিত মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দান করা জায়দাদনামার ঐতিহাসিক পুজো হিসেবে। চিরাচরিত রীতি মেনে গাজি পিরের দরগায় শিরনি দিয়ে সূচনা হয় এই দুর্গোৎসবের।
সম্প্রীতি আর সৌভ্রাতৃত্বের ঐতিহ্যই হাওড়ার আমতার গাজিপুরের সিংহ মজুমদার বাড়ির পুজোর মূল মন্ত্র। সেইসঙ্গে পরিবেশ সচেতনতায় নানা কার্যক্রম, রাজসিক মিলন, মহাভোজ এই দুর্গা 'উৎসবে'র বাড়তি পাওনা। সেইসঙ্গে সচিত্র পশু-পক্ষী পরিচিতির অনুষ্ঠানও এক অন্য মাত্রা পায় এই বনেদি বাড়ির পুজোয়। একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে সিংহমজুমদার বাড়ির পুজো মহামিলনোৎসবে বিরাজিত হয়ে আসছে আবহমানকাল।
সিংহমজুমদার বাড়ির পুজো আজও প্রচলিত মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দান করা জায়দাদনামার ঐতিহাসিক পুজো হিসেবে। চিরাচরিত রীতি মেনে গাজি পিরের দরগায় শিরনি দিয়ে সূচনা হয় এই দুর্গোৎসবের। হাওড়ার নারিট-গাজিপুরের সিংহমজুমদার বাড়ির মাতৃ আরাধনায় সন্ধিপুজো আর কুমারীপুজো হয়ে ওঠে আক্ষরিক অর্থেই একটা মহোৎসব।
তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে তাঁর সেনাপতি মান সিংহের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল এই সিংহমজুমদার বংশের। সেই সূত্রেই মুঘল দরবারে গুরুত্বপূর্ণ কার্যভারের দায়িত্বও এসে পড়েছিল রাঢ়-বাংলার সিংহমজুমদার পরিবারের এক পূর্বপুরুষের কাঁধে।
সুবে বাংলার জায়গিরদার ঈশাহক খানকে পরাজিত করে তাঁর পত্নী মেহেরুন্নেসাকে বিবাহ করেছিলেন পরবর্তী মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। সেইসময় বিশ্বস্ত অনুচরের ভুমিকা পালন করার পুরস্কার স্বরূপ রাঢ়বাংলার বিস্তীর্ণ দামোদর তীরবর্তী অঞ্চলের জায়দাদনামা লাভ করেছিল সিংহমজুমদার বংশের ওই পূর্বপুরুষ।
কথিত আছে, জাহাঙ্গীরের উদার মানসিকতায় সেইসময় অনেক মন্দির নির্মাণ হয় দামোদর তীরবর্তী ওই এলাকায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দামোদরের বন্যায় প্রবল ভাঙনের মুখে তলিয়ে যায় আমতার গাজিপুরের জায়দাদনামা সংলগ্ন বহু মন্দির। ধনসম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে সিংহমজুমদার পরিবার।
তখনই বাংলার নবাব ও বর্ধমান মহারাজার আর্থিক আনুকুল্যে এই পরিবারের রামানারায়ণ সিংহ স্থাপন করেন দুর্গা মন্দির। দু'শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরেই সূচনা হয় শারদোৎসবের। সেই থেকে আজও চলমান ঐতিহাসিক পুজো। পুজো এখানে আদতে রূপ নেয় উৎসবে। সে উৎসব মিলনের উৎসব। সম্প্রীতির উৎসব। সৌভ্রাতৃত্বের উৎসব।
মহাষষ্ঠীর দিন পরিবারের প্রবীণতম ব্যক্তি শারদোৎসবের সূচনা করেন। এই পুজোর প্রধান রীতিই হল গাজি পিরের দরগায় শিরনি দেওয়া। তারপর শুরু হয় মায়ের বোধন। এই রীতি আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। প্রতিদিনই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সপ্তমীর দিনে থাকে পরিবেশে সচেতনতার কার্যক্রম। সন্ধি-উৎসব শেষে এই পরিবারের দুর্গাপুজোয় অনুষ্ঠিত হয় বাংলার সচিত্র পশু-পক্ষী পরিচিতি। আর কুমারী পুজোর মহোৎসবে ফুটে ওঠে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের সামাজিক দায়বদ্ধতা। দশমীর দিন সিঁদুর খেলা রূপ নেয় মহামিলনের মহোৎসবে। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এই পরিবারের দুর্গোৎসবে অংশ নেন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ জন।
উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে সিংহমজুমদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় প্রার্থনা জানান, চিরদিন যেন একই বৃন্তে দু-টি কুসুমের মতো হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এলাকায় সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারেন। বাংলা সংস্কৃতিতে শারদোৎসবের দিনগুলি যেমন ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির ধারক-বাহক হয়ে ওঠে, সেই ধারা যেন অটুট থাকে। সিংহমজুমদার বাড়ির এই পুজোর প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ধাপ সেই বার্তাই বহন করে।