মিড ডে মিলে ভুতুড়ে অঙ্ক! ফের শিরোনামে দুর্গাপুর চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠ, তদন্তের আশ্বাস
ক্লাসে হাজির একটা সংখ্য়ার ছাত্র। কিন্তু, মিড মিল-এর খাতায় অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিতি। অবাক করা ঘটনা হলেও এমনই তথ্য সামনে এসেছে। ঘটনাস্থল নামখানার দুর্গাপুর চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠ।
ক্লাসে হাজির একটা সংখ্য়ার ছাত্র। কিন্তু, মিড মিল-এর খাতায় অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিতি। অবাক করা ঘটনা হলেও এমনই তথ্য সামনে এসেছে। ঘটনাস্থল নামখানার দুর্গাপুর চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠ। মাস খানেক আগেই শিরোনামে আসে এই বিদ্যালয়। অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের দুই স্থানীয় নেতা কিছু বহিরাগতদের নিয়ে এসে স্কুলের শিক্ষকদের উপরে হামলা করেন। এই গোটা ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।
সেই ঘটনার রেশ ধরেই এরপর এই চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠ নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। এমনকী এই ঘটনায় সম্প্রতি স্কুলে এসে বৈঠকে মার খাওয়া শিক্ষকদের চাবকে পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন ডিআই নজরুল আলি সিপাহি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও ওঠে স্কুলে শান্তি বৈঠকে তিনি রীতিমতো তৃণমূলের হয়ে সওয়াল করেন। শিক্ষকরা কেন আব্দুল মান্নান, সুজন চক্রবর্তীদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তা নিয়েও ডিআই-এর বিরুদ্ধে চোখ-রাঙানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠে এখন যা হচ্ছে তা আদতে একদিন না একদিন হওয়ারই কথা ছিল মনে করছেন বহু স্থানীয় অভিভাবক। এঁদের মতে, যে ভাবে দিনের পর দিন এই স্কুল-কে ঘিরে নানা দুর্নীতি চলছে তাতে পঠন-পাঠনের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই দুর্নীতির মধ্যে অন্যতম মিড ডে মিল বলেও অনেকের অভিযোগ। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে এঁরা সংবাদমাধ্যমেও পরিচয় দিতে চাইছেন না। পরিচয় প্রকাশ্য়ে এলে প্রাণ সংশয় হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
অভিযোগ, এই মিড মিল নিয়ে ২০১২ সাল থেকে দুর্নীতি শুরু। আজ তা ডাল-পালা মেলতে মেলতে বিশাল আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ, মূলত ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত মিড ডে মিল দেওয়া হয়। একটা ক্লাসে যত সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত থাকে তার সঙ্গে মিড ডে মিল-এর যে খাতা তার সংখ্যার কোনও মিল নেই। মিড ডে মিল-এর খাতায় ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির যে অঙ্ক দেওয়া হয় তা অনেকটাই বেশি। কেউ যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য মিড ডে মিল নেওয়া সব ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা-তে রোজ কারচুপি করা হয় না। আজ ক্লাস ফাইভে সংখ্য়ায় কারচুপি করা হচ্ছে তো ক্লাস সেভেনে-এর সংখ্যাটা ঠিক রাখা হচ্ছে। আবার অন্যদিন ক্লাস সেভেনের সংখ্য়াতে কারচুপি করা হচ্ছে তো অন্য ক্লাসের সংখ্যাটা ঠিক রাখা হচ্ছে। এইসব অভিভাবকদের অভিযোগ, অত্যন্ত মাথা খাটিয়ে পরিকল্পিতভাবে এই দুর্নীতি চলছে।
এখানেই শেষ নয়, আরও অভিযোগ, স্কুলে যেদিন পরীক্ষা হয় সেদিন সাধারণত মিড ডে মিল দেওয়া হয় না। কিন্তু, ওই দিনেও মিড ডে মিল দেওয়া হয়েছে বলে নাকি এসএমএস পাঠানো হয়। অভিযোগ, দুর্গাপুর চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠে মিড মিলে দেওয়ার জন্য মাথা পিছু ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যত সংখ্যক থালা থাকা দরকার, সেটাও নেই। ফলে অনেকে বাড়ি থেকে থালা নিয়ে যেতে পারলে তবেই মিড ডে মিল পায়। মিড ডে মিল-এ ছাত্র-ছাত্রীদের মোট সংখ্যার ৮০ শতাংশের খরচ মেলে। অভিভাবকদের অভিযোগ, এই ৮০ শতাংশের মধ্যে চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠ কর্তৃপক্ষ কারচুপি করছেন।
অভিযোগ, মিড ডে মিলের জন্য যে চাল কেনা হয় তাতেও কারচুপি করা হচ্ছে। মিড ডে মিলের পুরো চাল স্কুলেই আসে না। দোকান থেকেই তা কালোবাজারি হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে হস্টেল রয়েছে। ছাত্রাবাসে থাকা ছাত্ররা খাওয়া বাবদ অর্থও দেন। কিন্তু, মিড ডে মিলের বেঁচে যাওয়া চাল সেখানে ছাত্রদের রেধে খাওয়ানোরও অভিযোগ উঠেছে।
অগাস্টের শেষ সপ্তাহে দুর্গাপুর চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠে যে হামলার ঘটনা ঘটে তার পিছনেও ছিল এই মিড ডে মিল দুর্নীতি। আক্রান্ত শিক্ষকদের অভিযোগ ছিল তাঁরা মিড ডে মিল-এর দুর্নীতি থেকে স্কুলে চলা নানা আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন বলে মার খেতে হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এই হামলা নিয়ে অভিযোগ করার সময়ও মিড ডে মিল-এর দুর্নীতির কথা ওই আক্রান্ত শিক্ষকরা জানিয়েছিলেন।
এই মিড মিল-এর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় তৃণমূল বুথ সভাপতি যদুপতি পণ্ডার নামও। মিড ডে মিলের দুর্নীতির একটা অংশ তাঁর কাছেও যায় বলে অভিযোগ করেছেন একদল অভিভাবক। এঁদের অভিযোগ কম করেও প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার দুর্নীতি চলছে। বছরে এই দুর্নীতির পরিমাণ অন্তত কয়েক লক্ষ টাকা। মিড ডে মিলের ডাইনিং করার জন্যও স্কুলে কয়েক লক্ষ টাকা এসেছিল। কিন্তু, অর্থ ফুরিয়ে গেলেও সেই ঘর ভিতের বেশি ওঠেনি। সম্প্রতি স্কুলের নানা ঘটনা নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে খোঁজ খবর শুরু হতেই সেই ডাইনিং তৈরির কাজ শুরু করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আশিস ভট্টাচার্য। টাকা কোথায় গেল? তাঁর যুক্তি ছিল স্কুলের নানা খাতে টাকা বকেয়া ছিল। তাতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। ব্লক আধিকারিক এই ডাইনিং তৈরির জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষককে সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও ডাইনিং তৈরির কাজ শেষ হয়নি।
মিড ডে মিল নিয়ে যাবতীয় দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আশিস ভট্টাচার্য। তাঁর দাবি,মিড ডে মিল-এর ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা নিয়ে কোনও কারচুপি হয়নি। এই বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা শাসক রত্নাকর রাও-এর সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
[আরও পড়ুন: রাজ্যে রথযাত্রার সূচনায় অমিত শাহ! 'ঝড়' তুলতে আসছেন ৩ হেভিওয়েট মুখ্যমন্ত্রী]
অভিযোগ, একটা স্কুলকে যতভাবে পারা যায় ততভাবে দুর্নীতির গহ্বরে ঠেলে ফেলা হয়েছে। আর এই ঘটনায় পুরোপুরি অভিযোগের আঙুল ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক আশিস ভট্টাচার্যের দিকে। স্কুলের বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও কয়েক বছর ধরে বিল বকেয়া। মোট বিলের অঙ্ক ষাট হাজার টাকার কাছাকাছি। রাজ্য বিদ্যুৎ দফতর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে। তারপরে এখন হুকিং করে সেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। একটা স্কুলকে এভাবে বিদ্যুৎ চুরি করতে হচ্ছে কেন? এর কোনও উত্তর নেই। যে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক চরিত্রের মানুষ হওয়ার ব্রত দেওয়া হয়। সেখানেই বিদ্যুৎ সরবরাহ চলছে চুরি করে, যা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ।
[আরও পড়ুন: ২০১৯-এ তারকা প্রার্থীর চমক বিজেপির তালিকায়! ক্রিকেটার থেকে অভিনেতা কে নেই]
চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকদের আক্ষেপ, এককালে এই স্কুলের খুব ভালো পঠন-পাঠনের পরিবেশ ছিল। কিন্তু, দুর্নীতির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়া এই স্কুলের ভবিষ্যত নিয়েই এখন চিন্তিত শিক্ষক ও অভিভাবকদের দল। স্কুলের মাথায় কম করেও ষাট লক্ষ টাকার দেনা। কোথায় থেকে এত বিশাল অঙ্কের দেনা হল তার কোনও সদুত্তর নেই। তারমধ্যে যখন-তখন স্কুলে চলে আসছে পাওনাদারদের দল। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তারা অর্থ ফেরতের দাবি জানাচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষকের কাছে। এই ধরনের পরিস্থিতি পড়ুয়াদের মনেরও উপরেও প্রভাব ফেলছে। বহু অভিভাবক তাদের ছেলে-মেয়েকে অন্য স্কুলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ। স্কুল শিক্ষা দফতরের নিস্ক্রিয়তা চঞ্চলাময়ী আদর্শ বিদ্যাপীঠের দুর্নীতির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ।