শেন ওয়ার্ন: কোথাও গিয়ে মিলেমিশে একাকার স্পিনের জাদুকর আর ফুটবলের রাজপুত্র
শেন কিথ ওয়ার্ন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যত স্পিনার এসেছেন তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সর্বকালের অন্যতম সেরা। শুধু স্পিনার হিসেবে বললে ভুল হবে। হয়তো সর্বকালের সেরা বোলার। এমন একজন বোলার যিনি শুধু খেলা নয়, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তার জীবনযাপন - সবকিছু দিয়ে একটি অনবদ্য চরিত্র হয়ে উঠেছেন। যা অনেকটা লার্জার দ্যান লাইফের মতো। বাঁচার মতো বাঁচা কাকে বলে সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন ওয়ার্ন। হয়ত বিতর্কিত। হয়ত কখনও অবাঞ্ছিত। কিন্তু তাতে কী? সব পারফেক্ট করতে হলে আর শেন ওয়ার্ন হওয়া হল কোথায়! তাঁকে নির্দ্বিধায় ক্রিকেটের দিয়োগো মারাদোনা বলা যেতে পারে। মাদক, মহিলা কেচ্ছা, যৌন কেলেঙ্কারি- সবকিছু ক্রিকেটের পাশাপাশি সমান্তরাল রেখায় ঘটেছে শেন ওয়ার্নের জীবনে। তবে তা ক্রিকেট থেকে তাঁর ফোকাস নষ্ট হতে দেয়নি। এই একটা জিনিসই বুঝিয়ে দেয় কত বড় ক্রিকেটীয় প্রতিভা ছিলেন শেন ওয়ার্ন।
একই বিষয় কিন্তু মারাদোনার ক্ষেত্রেও বলা যায়। মাদক সেবন ফুটবল রাজপুত্রের জীবনের অঙ্গ ছিল। একের পর এক নারী সঙ্গ বদলেছেন। কখনও এক সঙ্গেই একাধিক। তারপর যথেচ্ছ ধূমপান তো ছিলই, ক্রমশ বেড়েছিল ওজন। একাধিক রোগ আগেই ছিল মারাদোনার। তারপর আকস্মিক মৃত্যু। শেন ওয়ার্ন-এর রোগ কতটা ছিল তা জানা যায়নি কিন্তু তিনি মনের দিক দিয়ে কোনওদিন ভালো ছিলেন না এই কথা অনেকবার জানা গিয়েছে তার ঘনিষ্ঠদের থেকে। এসব থেকেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। তারপর আকস্মিক মৃত্যু। তবে এরা দুজনেই মাঠের বাইরে যতটাই খারাপ ছিলেন মাঠের ভিতরে ততটাই দুরন্ত। মারাদোনা পায়ে বল পেলেই চমক দেখাতেন শেন হাতে বল পেলেই দিতেন চমক। মুকুটহীন দুই স্পোর্টস তারকা এভাবেই মনে থেকে গিয়েছেন খেলা প্রেমীদের। মাঠের বাইরের জীবন খারাপ হলেও মাঠের খেলা সবসময় সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিয়েছে আর সেটাই তাদের সেরা করে তুলেছে। ভাবমূর্তিকে নষ্ট হতে দেয়নি। তাই তো মারাদোনার মৃত্যুর পর আর্জেন্টিনা নয় সারা বিশ্ব শোকে মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। বহু মানুষকে দেখা গিয়েছিল চোখের জল ফেলতে। একইভাবে ওয়ার্ন-এর মৃত্যুর পরেও অনেকের চোখেই আজ জল। তারা সবাই ভুলে গিয়েছেন মাঠের বাইরের মানুষটা কেমন। মনে রয়েছে সেই সব চোখ ধাঁধানো ডেলিভারিগুলো। এভাবেই দুজন আলাদা খেলার জগতের হয়েও জীবনযাত্রা এবং আকস্মিক মৃত্যু তাদেরকে একই জায়গায় নিয়ে চলে এসেছে।
ওয়ার্ন-এর কেরিয়ার
শেন ওয়ার্ন-এর শুরুটা করেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক দিয়ে। তার আগে খুব বেশি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেননি শেন ওয়ার্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আচমকা ঢুকে পড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলে।১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিম্বাবোয়ে সফরে অস্ট্রেলিয়া বি দলের জন্য নির্বাচিত হন ওয়ার্ন। সেখানে এক ইনিংসে সাত উইকেট নিয়ে নেন। তারপর দেশে ফিরলে তাঁকে খেলানো হয় অস্ট্রেলিয়া এ দলে। সেই সময় অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। তাদের বিরুদ্ধে খেলেন ওয়ার্ন। এরপরে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ভারত। ভারতের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া দলে তখন স্পিনের দায়িত্ব সামলেছেন পিটার টেলর। তবে প্রথম দুটি টেস্টে তিনি চূড়ান্ত ব্যর্থ হন। পান মাত্র একটি উইকেট। এরপরই তৃতীয় টেস্টে প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পড়ে শেন ওয়ার্নের। দেশের জার্সিতে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নেমে অবশ্য শুরুটা মনে রাখার মতো হয়নি ওয়ার্নের। সিডনিতে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে মাত্র একটি উইকেট পান শেন ওয়ার্ন। আউট করেছিলেন ম্যাচের সেরা রবি শাস্ত্রীকে। সেই ম্যাচে ১৫০ রান দিয়ে একটি উইকেট নেন ওয়ার্ন। চতুর্থ টেস্টের অ্যাডিলেডে ৭৮ রান দিয়ে কোনও উইকেট পাননি। যার ফলে পঞ্চম টেস্টের পারথের সবুজ পিচে বাদ পড়েন ওয়ার্ন। পরের সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে কলম্বোতে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে তিনি ১০৭ রান দিয়ে কোনও উইকেট নিতে পারেননি। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে কোনও রান না দিয়ে তিন উইকেট তুলে নেন এবং অস্ট্রেলিয়া ১৬ রানে দারুণ এক জয় পায়। শেন ওয়ার্নের রেকর্ড তখনও পর্যন্ত বলার মতো ছিল না। ফলে পরের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নির্বাচকরা তাঁকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেন। তাঁর জায়গায় অস্ট্রেলিয়া দলে খেলেছিলেন গ্রেগ ম্যাথিউস। তবে টার্নিং পিচেও ম্যাথিউস উইকেট নিতে ব্যর্থ হন। যার ফলে দ্বিতীয় টেস্টে ফের একবার দলে ফিরলেন শেন ওয়ার্ন। আর সেই টেস্ট থেকেই গোটা ক্রিকেটবিশ্ব চিনতে শুরু করল স্পিনের জাদুকরকে। মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্ট দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫২ রানে ৭ উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়ে দেন শেন ওয়ার্ন। সেই শুরু, তারপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।