চুমুটা সহপাঠীকে না খেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে খান তো দেখি... বুঝব তাহলে আমি কিছুই করিনি
যাঁরা গদগদ হয়ে চুমু খেয়ে সমাজকে পথে আনার চেষ্টা করছেন আর কেউ তাঁদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাভোগের কায়দা দেখে অস্বস্তি বোধ করলে তাঁকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করছেন অবলীলায়, তাঁদের উদ্দ্যেশে এই লেখকের প্রশ্ন: আপনাদের মাখড়ার পথ মাড়াতে তো দেখলাম না? নাকি দক্ষিণ কলকাতার নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিট পরিবেশের বাইরে যেখানে হয়ত মিডিয়ার ওবি ভ্যান, খবরপিপাশু সাংবাদিকের মাইক্রোফোন এবং মধ্যবিত্তের মতো উপভোক্তার এক বড় অংশের উপস্থিতি থাকবে না, সেখানে আপনাদের প্রতিবাদ করতে ভালো লাগে না?
সম্প্রতি একজন সম্মানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়তে অনুষ্ঠিত (এই কথাটা জেনেবুঝেই ব্যবহার করলাম কারণ আজকাল সব ব্যাপারেই একটা উত্সব-উত্সব ভাব থাকে) প্রতিবাদটিকে 'এলিটিস্ট' আখ্যা দেওয়াতে চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠল দেখলাম, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি এই চুমু প্রতিবাদটি আবার প্রমাণ করল যে প্রফেসর সমাদ্দারের বক্তব্যটিই যথার্থ |
বর্তমান সময়ে আন্দোলনের সংজ্ঞাটাই বদলে গিয়েছে | আর সেটা শুধু বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে নয় | এখন সারা দুনিয়া জুড়েই দেখা যাচ্ছে যে প্রতিবাদের ভাষা মানেই হয় কট্টরপন্থা আর নয়তো অন্তঃসারশূন্য বিরোধিতা | কোনও সমস্যা দেখা দিলে, তা যে ক্ষেত্রেই হোক, প্রতিবাদ করা মানে এই নয় যে সেটা পাবলিসিটির জন্যে চলতেই থাকবে | প্রতিবাদের একটা এজেন্ডা, একটা লক্ষ্য থাকা জরুরি | কিন্তু আজকাল প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে যত বেশি প্রচারের আলোয় থাকা যায় | মাসকয়েক আগে পর্যন্ত অরবিন্দ কেজরিয়ালকে দেখতাম এই একই পন্থা অনুসরণ করতে যার শেষ পরিণাম হয়েছিল নিতান্তই হাস্যকর |
যাদবপুরের ওই ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে প্রতিবাদ দেখেও সেরকমই মনে হল | যুগ বদলেছে মানছি | এখন আর ষাট কিংবা সত্তরের দশকের মতো মতাদর্শের লড়াই আর নেই কিন্তু মতাদর্শ না থাকলেও একটা ন্যূনতম আদর্শ তো নতুন প্রজন্মের কাছে আশা করা যেতেই পারে? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে ঘরের ছেলেমেয়েরা এই প্রতিবাদ করছে, এঁদের কাছে শেষ পর্যন্ত এঁদের বিশ্ববিদ্যালয়টিই শেষ কথা | এঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার মতো আধুনিক মাধ্যমের মারফত প্রতিবাদ করেন, গান-কবিতা লেখেন, ইন্টেলেকচুয়ালি যথেষ্ট ভালো... কিন্তু মুশকিল হলো এঁদের দুনিয়ার পরিধিটা খুবই সঙ্কুচিত এবং প্রতিবাদের ধারাকে তুলে ধরতে এঁদের ভরসা সেই মিডিয়ার ছবি বা প্রিন্টই |
সেই সুযোগে যদি একটু সাহেবী কেতায় চুমু-টুমু খেয়ে নিজেদের 'আধুনিকতা' দেখানো যায় চারদিকে, ক্ষতিটা কী? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল নামক যে ছিন্নমূল রাজ্যশাসন করছে, তাকে সামলাতে তো নরেন্দ্র মোদির বিজেপি-ই রয়েছে | আমরা বরং ফরাসী সাজি | বাঙালিয়ানার উপরে উঠে আমরা তো এখন বিশ্বায়িত দুনিয়ার নাগরিক | দুদিন পরে বেঙ্গালুরু বা সিয়াটলে সেটল করব, তখন এই সব ছবির সাহায্যে ফেসবুকে আমাদের জাত্যাভিমান জ্বলজ্বল করবে |
এই প্রতিবাদী যুবক-যুবতীদের প্রতি আমার সীমিত প্রশ্ন: যাদবপুরের অনেক ছাত্রছাত্রী আছেন যাঁরা গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছেন, রোজ অনেক কষ্ট করে, অনেক দূর থেকে আসেন পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, তাঁদের অসুবিধা নিয়ে আপনারা কখনো কলরব কি তোলেন? যখন সারদা কেলেঙ্কারিতে লোকে সর্বস্ব খোয়ায় বা কামদুনির একটি পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণ করে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়, তখন তো আপনাদের কলরবের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায় না |
যদিও আপনারা বামপন্থী না ডানপন্থী আমি বুঝতে পারিনি, তবু আপনাদের প্রশ্ন: এই যে লড়াই আপনারা করছেন (কেউ কেউ দেখলাম মুখোশ-জাতীয় কিছু পরে গিয়েছেন চুমু প্রতিবাদে, তাঁদের কি 'বাড়িতে কেউ দেখে যদি দেখে ফেলে' ধরনের ভয় ছিল?) তার সামাজিক বার্তাটি কী যদি একটু বলেন | যেই স্কুলছাত্রীটি চুমুর দাপট দেখে তার অভিভাবককে জিগ্যেস করেই ফেলে যে ব্যাপারটা খুব মজাদার কিনা, তার প্রতি কি বার্তা গেল? নাকি আপনারা সেসব নিয়ে ভাবিতই নন? বামপন্থী ঘরানায় উদারবাদের জিগির তুলে আপনাদের এই জগাখিচুড়ি প্রতিবাদের ভাষা যেমন মাঝারি মানের, তেমনই ফাঁপা তার ভিতর | নীতিপুলিশের মোকাবিলা করতে হয় তো সেটা ঠিকঠাক উপায়ে করুন | কেরালাতে হয়েছে বলে আমরাও হুজুগে মাতব, এটা এলিট সম্প্রদায়ের সময় নষ্ট করার একটি কায়দা হতে পারে, কিন্তু সমাজকে পথ দেখানোর পথ নয় | আপনাদের প্রধান লক্ষ্যটা কী? সাম্য না ভাঁড়ামো?
আর একটা কথা | মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন-এলিট পরিচিতির প্রতি যে সামাজিক শ্রেণীর ঘৃণা সর্বজনবিদিত, এই সমস্ত হোক কলরব-তব তারই মস্তিষ্কপ্রসূত | এখানেই সমস্যা | রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা আমার হয়তো থাকতে পারে, কারণ আমি এখন একজন সুবিধাবাদী নাগরিক, কিন্তু ছাত্রদের তো রাজনৈতিক সমীকরণের উর্ধ্বে থাকা উচিত | সেটা কি তাঁরা রয়েছেন? না, কারণ নব্য-উদারবাদী দুনিয়ার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট অবহিত এবং পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকাটাও এঁরা ভালই বোঝেন | আজকের ছাত্রজীবনে একটু প্রচারমুখী অভিনব প্রতিবাদ করে কালকের কথা ভাবলেই চলবে তাঁদের | ষড়যন্ত্র চলুক না, আপনি বাঁচলে কেরিয়ারের নাম |
কী আর করণীয়? সারা দুনিয়ারই এই একই সমস্যা এখন |