এভাবেই জাপানি বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল খিদিরপুর ডক
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কলকাতা ছিল ব্রিটিশ এবং আমেরিকার সেনাদের বড় ঘাঁটি। তারই মধ্যে ১৯৪২-৪৩ সাল নাগাদ কলকাতায় জাপানি সেনার আক্রমণ শুরু হয়। ১৯৪২ সালে কলকাতায় বোমা পড়ে। খিদিরপুরের ডকের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই পুরো আক্রমণটাই চালানো হয়েছিল জাপানি বিমানবাহিনীর তরফে। দিনের আলোয় ব্রিটিশ সেনারা যুদ্ধ সামলে নিতে পারত। কিন্তু রাতের অন্ধকারে জাপানি বিমান হানা হয়ে উঠত ভয়ঙ্কর। জাপানিদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শহরের বাড়ি, স্থাপত্য, রাস্তাঘাট। আর তাই রাতে 'ব্ল্যাক আউট'-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শহর বাঁচাতে। বাড়িঘরের আলো যেমন নেভানো থাকত, তেমনই রাস্তাঘাটের আলো নিভিয়ে দেওয়া হত সন্ধ্যার পর থেকেই।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কলকাতা বন্দর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গ্রাস করেছিল খিদিরপুরকে। আসলে এই বন্দর ছিল দূরপ্রাচ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশদের সাপ্লাই লাইন। জাপান চেয়েছিল সাপ্লাই লাইন বন্ধ করতে। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৪২ সালের ২০শে ডিসেম্বর এয়ার স্ট্রাইক করেছিল জাপানি বোমারু বিমান। এয়ার স্ট্রাইকের মূল লক্ষ্য ছিল কলকাতা বন্দর এলাকা। এরপর বেশ কয়েকবার বোমাবর্ষণ করা হয়। খিদিরপুর ডক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল একাধিক ঘরবাড়ি। মৃত্যুর মিছিল দেখেছিল সেদিনের কলকাতা। অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল সমগ্র খিদিরপুর এলাকাজুড়ে। শুধু একবার নয় ময়দান চত্বর জুড়ে বারবার বোমা বর্ষিত হয়েছিল। এই বোমাবর্ষণ মূলত সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সম্পন্ন হত। সারা কলকাতাকে অন্ধকার করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এইভাবেই এক চলমান ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে এই খিদিরপুর।
কলকাতার চলমান ইতিহাসের এক ঐতিহ্যের সাক্ষী আজকের কলকাতা বন্দর এলাকা। যা কমবেশি আমর খিদিরপুর ডক নামে জেনে থাকি।খিদিরপুরে ডক কবে তৈরি করা হল? উনবিংশ শতকে ভারতবর্ষ ছিল ইংরেজদের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র। কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করা অথবা ইংল্যান্ড থেকে শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী ভারতবর্ষে নিয়ে আসা এই ছিল তাদের মূল ব্যবসা। আজকের কলকাতা অবশ্য তখন ভারতের রাজধানী ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ছিল একটা আধুনিক বন্দর। বন্দর হওয়ার আগে থেকেই গঙ্গা পাড়ে জাহাজ নোঙর ফেলত ঠিকই কিন্তু ব্যবসার প্রসার ঘটলে প্রয়োজন ছিল বৃহৎ আকৃতির জাহাজের প্রবেশ। আর তার জন্য আধুনিক বন্দরের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল ১৮৪২ সাল থেকে। এই চিন্তাভাবনা অবশ্য বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮৩৩-৩৪ সাল থেকে মোটামুটিভাবে এরা কাজকর্ম শুরু করেছিল। সময় যত গড়িয়েছে চিন্তাভাবনা বাস্তবতা লাভ করেছে। ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটা পোর্ট কমিশন। অবশ্য এর এক বছর আগে থেকেই ভারী যন্ত্রের সাহায্যে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়েছিল খিদিরপুর ডকে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৮৪ সালে খিদিরপুর অঞ্চল বন্দর তৈরি করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। জমি পাওয়ার পর জোর কদমে কাজও শুরু হয়েছিল এবং মোটামুটি ভাবে ১৮৯২ সালে বন্দর নির্মাণ শেষ হয়। এই সময়েই যান্ত্রিক উপায়ে জলের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিও শুরু হয়েছিল। দিনটা ২০শে জুন, ১৮৯২ সাল বিশাল আকৃতির ব্রিটিশ জাহাজ "লুসিয়ে" প্রবেশ করেছিল কলকাতা বন্দরে। তখন থেকেই কলকাতা বন্দর হয়ে উঠল ব্যবসা বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর। সময় যত এগিয়েছে বন্দর আরো আধুনিক হয়েছে। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ-এর নামে কলকাতা বন্দরে গড়ে তোলা হয়েছিল আরো একটি বৃহৎ আকৃতির ডক। স্বাধীনতার পর নামকরণ করা হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র ডক।
এই কলকাতা বন্দর একাধিক ইতিহাসের সাক্ষী। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উপনিবেশ উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আখ উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যার জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রমিক। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৩৩ সাল নাগাদ সারা পৃথিবী জুড়ে দাসত্বকে বেআইনী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পাকাপোক্তভাবে বন্দর গড়ে ওঠার আগেই ১৮৩৮ সাল থেকে ভারতীয় শ্রমিকদের প্রেরণ করা হত বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশ। বন্দর আধুনিক হয়ে উঠলে শ্রমিক প্রেরণ করার সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। লাখো লাখো শ্রমিককে পাঠানো হয়েছিল মরিশাস, ত্রিনিদাদ, জামাইকা, পূর্ব আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে। এই এই গঙ্গা নদীর পাড়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের অন্য দেশে পাঠানোর আগে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা ছিল। এই ভাবেই হয়ত ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা বন্দর। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে আজকের খিদিরপুরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় খিদিরপুর ডক অঞ্চলের তাৎপর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।