সাবেকিয়ানায় চির উজ্জ্বল শতাব্দী প্রাচীন বাগবাজার সর্বজনীন
আধুনিক যুগে থিমের যুদ্ধে গিয়ে নয়, বরং সাবেকিয়ানা অক্ষুণ্ণ রেখে শতাব্দী ধরে ঐতিহ্য বজায় রেখেছে উত্তর কলকাতার অন্যতম আকর্ষণীয় পুজো বাগবাজার সর্বজনীন। প্রতি বছরই প্রতিমা দেখতে ভিড় জমান লক্ষাধিক দর্শনার্থী। এই পুজো মন্ডপ চত্বরে বসে বিশাল মেলাও। তবে এই পুজোর মূল বড় আকর্ষণ হল নজরকাড়া মাতৃপ্রতিমা।

প্রতি বছরই এখানের প্রতিমা হয় একচালার। যার পুরো সাজটাই ডাকের। সেই সঙ্গে শেষবেলায় সিঁদুর খেলা। বিজয়ার দিন সকাল থেকেই দেবী দুর্গাকে লক্ষ্য করে লাইন পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে মহিলারা ভিড় জমান এখানে মাকে সিঁদুর দিতে। নিজেরাও মেতে উঠেন সিঁদুর খেলায়। যা নিয়ে গর্বিত এই ঐতিহ্যবাহী পুজো কমিটি।
পুজো কমিটির কিছু প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেকালের কলকাতায় বাবুদের বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় এই চির-পরিচিত বারোয়ারি পুজোর। সেকালের বাবুদের বাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত। থাকত হাজারো আলোর রোশনাই। ঢাকের আওয়াজে গমগম করত গোটা এলাকা। কিন্তু সেই প্রতিমা দেখার সৌভাগ্য সবার ছিল না। বাবুদের দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির মূল দরজায়। থাকত বাবুদের লেঠেল।
স্থানীয়দের চোখের সামনে দেশ বিদেশ থেকে অতিথি আসত অথচ তাদের ঢোকার অধিকার ছিল না। যদি ভুলবশত কেউ ঢোকার চেষ্টা করত তাহলে পিঠে পড়ত লাঠি-চাবুকের মার। ঠাকুর দেখতে গিয়ে তাই মার খেয়ে ফিরে আসত গরিব-দুখীজনেরা। সেই রাগ-দু্:খ-ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় এই বারোয়ারি পুজোর।

১৯১৯ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় ১২ জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে পুজো করবেন বলে ঠিক করেন । সেই থেকে শুরু। যা এবার ১০০ বছরে পড়তে চলছে। নেবুবাগান লেন ও বাগবাজার স্ট্রিটের মোড়ে ৫৫ নম্বর বাগবাজার স্ট্রিটে এই পুজো শুরু হয়েছিল। নাম ছিল 'নেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো'। এখানেই কয়েক বছর পুজো হয়। ১৯২৪ সালে পুজোটি সরে যায় বাগবাজার স্ট্রিট ও পশুপতি বোস লেনের মোড়ে। পরের বছর ফের সরে যায় কাঁটাপুকুরে। ১৯২৭ সালেও স্থানান্তরিত হয় এই পুজো। সেবছর দুর্গাপুজো হয়েছিল বাগবাজার কালীমন্দিরে।
১৯৩০ সালে বিখ্যাত আইনজীবী তথা তৎকালীন কলকাতা পুরসভার কর্তা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় পুজোটি নতুন চেহারা পায়। নাম হয় 'বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসব ও প্রদর্শনী'। তাঁরই উদ্যোগে পুজো উঠে আসে কর্পোরেশনের মাঠে। তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু এই অনুমতি দেন। শুধু পুরসভার মাঠ ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তা-ই নয়, পুরসভা তখন বাগবাজারের এই পুজোয় চাঁদাও দিত।

তবে এখন আর প্যান্ডেল বেঁধে নয় । গঙ্গার ধারে বলরাম বসু ঘাটের উপরে জোড়া শিবমন্দিরের পাশেই তৈরি করে নেওয়া হয়েছে মঞ্চ । তবে, বারোয়ারি পুজো হলেও সাবেকি রীতি বজার রেখেই এই দুর্গা ঠাকুরকে পুজো করা হয় এই মণ্ডপে।
পুজো কমিটির উদ্যোক্তা শশাঙ্ক সাহা জানিয়েছেন, এই পুজোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার হরিশঙ্কর পাল প্রমুখের মত বহু বিশিষ্ট জনেরা। একশো বছর উপলক্ষ্যে এবছর আলাদা কিছু উদ্যোগ নেবে বাগবাজার সার্বজনীন৷ যেমন প্রভাত ফেরীর আয়োজন করা হতে পারে৷ এছাড়া বাগবাজার বাটার মোড় পর্যন্ত আলোকসজ্জা করা হবে৷'