বরাহনগরের স্কুলে পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর মোড়, চাপে পড়ে দোষ স্বীকার প্রধানশিক্ষকের
বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরে তিনি পড়ুয়াদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেন। এই অভিযোগ অবশেষে স্বীকার করে নিলেন প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ।
বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরে তিনি পড়ুয়াদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেন। এই অভিযোগ অবশেষে স্বীকার করে নিলেন প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ। ২ অক্টোবর ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি প্রথম প্রকাশ্যে আনে বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরে চলা বিভিন্ন অনিয়ম এবং বেনিয়মের ছবি। ভিডিও প্রকাশ করে দেখানো হয় কীভাবে প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ পড়ুয়াদের আঙুলের ফাঁকে কলম ঢুকিয়ে মচকে দিচ্ছেন। আর পড়ুয়ারা ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠছে।
সরকারি স্কুলের মধ্যে শিক্ষার অধিকার আইন-কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে 'শিক্ষারত্ন' পাওয়া প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ এই অত্যাচার দিনের পর দিন চালিয়ে আসছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও মণীশকুমার নেজের বিরুদ্ধে সরকারি স্কুলের মধ্যে বাইরের প্রকাশন সংস্থার বই বিক্রি থেকে শুরু অর্থ নিয়ে পড়ুয়া ভর্তি এবং বিভিন্ন কাজে কাটমানি খাওয়া এবং নানা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগও সামনে আসে।
গোটা ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। জেলাশাসকের নির্দেশে ডিআই অফ স্কুলস সঞ্জয়কুমার চট্টোপাধ্যায় তদন্ত শুরু করেছিলেন। এই তদন্তে বেনিয়মের হদিশও মেলে। ১০ অক্টোবার বারাসতে ডিআই শুনানি-র জন্য অভিযুক্ত প্রধানশিক্ষক মণীশ কুমার নেজ এবং তাঁর স্কুলের বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ডেকে পাঠান।
এই শুনানি চলাকালীন মণীশ কুমারের কাছ থেকে মূলত তিনটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়। এই তিনটি বিষয় হল অর্থ নিয়ে পড়ুয়া ভর্তি, বাইরের প্রকাশন সংস্থার বই স্কুলে বিক্রি করা ও পড়ানো এবং পড়ুয়াদের শারীরিক নিগ্রহ। স্কুল শিক্ষা দফতরের সূত্রে খবর, শুনানিতে শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একসঙ্গে বসানো হয়েছিল। উল্টো দিকে ছিলেন ডিআই সঞ্জয়কুমার চট্টোপাধ্যায়, এআই সন্দীপন সর্বোগ্গো, এসআই সুস্মিতা মুখোপাধ্যায় এবং আরও দুই আধিকারিক।
স্কুল শিক্ষা দফতরের বিশেষ সূত্রে খবর শুনানিতে মণীশকুমার নেজ প্রথমে নানা ওজর-আপত্তি তুলে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করতে চাইলেও শেষমেশ তিনি দোষ হয়েছে বলে স্বীকার করেন।
শিক্ষার অধিকার আইন ২০১১ সাল থেক শিক্ষার অধিকার আইনে শিক্ষালয়ে পড়ুয়াদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু, তারপরেও কেন পড়ুয়াদের শারীরিক নির্যাতন? প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ-কে এমন প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়। মণীশকুমার প্রথমে দাবি করেন ভিডিওটি এক বছর আগের। কিন্তু, এক বছর আগের হলেও তা ২০১১ সালের পরে বলে শুনানিতে উপস্থিতি আধিকারিকরা জানিয়ে দেন। এরপর মণীশকুমারের যাবতীয় রক্ষণাত্মক অবস্থান ভেঙে পড়ে। চাপে পড়ে তিনি স্বীকার করেন পড়ুয়াদের মারধর করাটা অন্যায় হয়েছে।
স্কুলের মধ্যে বাইরের সংস্থা-র বই বিক্রি এবং অর্থ দিয়ে পড়ুয়া ভর্তি নিয়েও তির্যক প্রশ্নের সামনে পড়তে হয় মণীশকুমার নেজকে। প্রধানশিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের মধ্যেই এইভাবে অনিয়নম করে আসছেন তাতে বাকি শিক্ষকরা কেন প্রতিবাদ করেননি? স্কুল শিক্ষা দফতরের আধিকারিকরা এই নিয়ে শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে উত্তর চান। এই অনিয়মে সহ-শিক্ষক-শিক্ষিকারা চুপ করে থাকায় সকলকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়। যদিও, সরকারের তৈরি করা এক্সপার্ট কমিটির সুপারিশ করা ফ্রি- বই-এর বাইরে বহিরাগত প্রকাশনার বই বিক্রি করাটা একটা গর্হিত অপরাধ। তাতে শুধু সতর্কতা কেন? তা নিয়ে কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
অর্থ নিয়ে পড়ুয়া ভর্তি কোনওভাবেই করা যাবে না বলে সতর্ক করে দেওয়া হয় প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজকে। স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর মণীশকুমার নেজের বিরুদ্ধে আপাতত পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডে চার্জশিট তৈরি করা হচ্ছে। সেইসঙ্গ পুরো রিপোর্টটি জেলাশাসকে দেওয়া হচ্ছে। চার্জশিটের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন মণীশকুমার নেজ। এরপরই মণীশকুমারকে নিয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে স্কুল শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর।
বিষয়টি নিয়ে ডিআই অফ স্কুলস-এর প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে, তিনি জানান শুনানি হয়েছে। শুনানিতে যা হয়েছে সে ব্যাপারে জেলাশাসককে প্রথমে মৌখিক পরে লিখিত রিপোর্ট দেওয়া হবে। মণীশকুমার নেজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইল নম্বর আনরিচেবল ছিল।
এদিনের শুনানিতে মণীশকুমার নেজকে অবশ্য আরও একটি বিষয়ে স্কুল শিক্ষা দফতর থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর মণীশকুমার নেজ বেশকিছু অভিভাবককে নানাভাবে বুঝিয়েছিলেন স্কুল কর্পোরাল পানিশমেন্ট চলতেই পারে। এমনকী, এইসব অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া ভিডিওবন্দি করেছিলেন মণীশকুমার। স্কুল শিক্ষা দফতর থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও অভিভাবক যদি কর্পোরাল পানিশমেন্টের পক্ষে সওয়াল করেন তাহলে তিনি-ও অপরাধী এবং এই সব অভিভাবকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে স্কুল শিক্ষা দফতর।