তাপপ্রবাহ থেকে দাবানলে দগ্ধ বিশ্ব! জলবায়ু পরিবর্তনের যে মাশুল দিতে হয়েছে একুশে
তাপপ্রবাহ থেকে দাবানলে দগ্ধ বিশ্ব! জলবায়ু পরিবর্তনের যে মাশুল দিতে হয়েছে একুশে
বিশ্ব এখনও করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও নতুন নতুন রূপের আবির্ভাব হচ্ছে। ওমিক্রন হানায় ত্রস্ত বিশ্ব। এই অবস্থায় আমরা ২০২১ সাল শেষ করতে চলেছি। শুধু করোনার হবানাই নয়, এবার বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে দাবানল ও তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও বিধ্বস্ত করেছে নানা দেশকে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি
বিজ্ঞানীরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা উভয়ই আরও বৃদ্ধি পাবে আগামী দশকে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও ভয়াবহ রূপে আঘাত করবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। দুই দশকের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব ২১-এ
বিজ্ঞানীরা, জলবায়ু কর্মীরা এবং পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারকে চাপ দিয়েই চলেছেন। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। যার জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়ন। ২০২১-এ এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাপপ্রবাহ, কানাডার সর্বনাশ
প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিমে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ওই এলাকায় রেকর্ড তাপমাত্রার কারণে মানুষ বাইরে বের হতে পারেননি। দুই দেশে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাপপ্রবাহের ফলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি তাপ এবং দীর্ঘায়িত খরার একটি বিপজ্জনক সঙ্গম ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
লা নিনার কারণে শক্তিশালী উচ্চ-চাপ বায়ুমণ্ডল
লা নিনার কারণে শক্তিশালী উচ্চ-চাপ বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে উচ্চ-চাপের 'গম্বুজ'-এর নীচে আটকে থাকা উত্তাপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তৈরি হয়। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর-পশ্চিমাংশ এমন একটি অঞ্চল যা সাধারণত শীতল, বৃষ্টির আবহাওয়ার জন্য পরিচিত। সেখানে গরম, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের কারণ হয়ে ওঠে ওই তাপপ্রবাহ।
আকস্মক বন্যায় নিমজ্জিত জার্মানি-বেলজিয়াম
পশ্চিম ইউরোপের কিছু অংশে ঝড়ের কারণে নদী ও জলাধারগুলির বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। এর ফলে আকস্মিক বন্যা পশ্চিম জার্মানি এবং বেলজিয়ামে ১৭০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু এখানকার মাটি বেশি জল শোষণ করতে পারে না, তাই এই অঞ্চলে মাটি ফেটে গিয়ে আকস্মিক বন্যার সূত্রপাত ঘটায়।
দুই মাসের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত দুই দিনে
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, গ্রীষ্মে বায়ুমণ্ডলের সঞ্চালনে দুর্বলতা, দীর্ঘস্থায়ী আবহাওয়ার ধরন তাপপ্রবাহ বা অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণ ছিল। ফরাসি জাতীয় আবহাওয়া পরিষেবার মতে, দুই মাসের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত দুই দিনে কিছু এলাকায় পড়েছে। এরপর জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বন্যাকে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেন।
চিনের অভূতপূর্ব ফ্ল্যাশ বন্যা
বছরের শুরুতে মধ্য চিনের হেনান প্রদেশে এক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান। হেনান প্রদেশের রাজধানী ঝেংঝুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ এখানে মারা গিয়েছেন। ১৫০টি কাউন্টি-স্তরের অঞ্চলে ১৪.৫৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রবল বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১.০৯ মিলিয়ন হেক্টরেরও বেশি জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং ৩০,৬০০ টিরও বেশি বাড়ি ধসে পড়েছে।
জীবনে একবারই ঘটে এ ধরনের ঘটনা
ঝেংঝোতে তিন দিনের ব্যবধানে ৬১৭.১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা শহরের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণের কাছাকাছি। শহরটিতে প্রতি ঘণ্টায় ২০১.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের হারও নথিভুক্ত করা হয়। বিশাল বন্যা, যাকে আবহাওয়াবিদরা জীবনে একবারই ঘটে বলে বর্ণনা করেছেন। ফলে ঝেংঝোতে সর্বপ্রথম এ ধরনের বৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে পাবলিক অ্যাভিনিউ এবং পাতাল রেলের টানেলগুলি জলে তলিয়ে গেছে৷
তুরস্ক-গ্রিসজুড়ে মারাত্মক দাবানল
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের যে দাবানল হয়েছে তা মহাদেশের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে। সেইসঙ্গে শক্তিশালী ঝড়ের কারণে এবার বেশি ধ্বংসাত্মক ছিল দাবানল। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের দাবানলের ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা উভয়ই বাড়িয়ে দিয়েছে।
তুরস্কে অগ্নিকাণ্ড
শুধুমাত্র তুরস্কেরই এজিয়ান এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে ১৭টি প্রদেশে ১০০টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। ২০২১ সালে ১৩৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমি পুড়ে চাই হয়ে গিয়েছে, যা গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তুর্কি দাবানল উত্তর আফ্রিকা থেকে উত্তপ্ত বাতাস দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল, যা এই বছর ভূমধ্যসাগরকে প্রান্তে ইউরোপীয় তাপপ্রবাহের ফলে আরও খারাপ হয়েছিল।
৪০টিরও বেশি দাবানলের ঘটনা গ্রিসে
এদিকে, গ্রিসে এই ধরনের ৪০টিরও বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। লেবাননের উত্তরে পার্বত্য অঞ্চলে পাইন বনের বিশাল অংশও আগুনে পুড়ে গেছে। গ্রিস এবং তুরস্ক উভয়েই জুলাই মাসে রেকর্ড তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেয়। তার ফলে ভয়াবহ দাবানলে দগ্ধ হয় গ্রিস ও তুরস্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
ভারতেও ভূমিধস বেড়েছে তীব্র বৃষ্টিপাতের জেরে
ভারতেও চরম আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে। কখনও তীব্র ঘূর্ণিঝড়, কখনও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টির কারণে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে বাংলায়। প্রবল বর্ষণে রাজ্যের অনেক অংশে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস হয়। উত্তরাখণ্ডে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে নিম্নচাপ এলাকা এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার মিথস্ক্রিয়ার ফলে তীব্র বৃষ্টি হয়েছে।
ঋষিগঙ্গা নদীতে মারাত্মক বন্যার সূত্রপাত
পাহাড়ী রাজ্যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, যখন ঋষিগঙ্গা উপত্যকায় বিশাল পাথর এবং তুষার ধসে পড়েছিল। ঋষিগঙ্গা নদীতে একটি মারাত্মক বন্যার সূত্রপাত করে ওই ধ্বংসাবশেষ, যা উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিশ্চিহ্ন করে দেয়, ৭০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যাযন এই ঘটনার ফলে।