বিশ্বকাপ ডায়েরি: হাসিমুখে আনন্দ উৎসবে স্বেচ্ছাসেবা
ব্রিটিশদের যত ভদ্রতা বা আদব কায়দা তা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে। এমন অভিজ্ঞতাই আমাদের প্রতিনিয়ত হচ্ছে।
ইংল্যান্ডে একদিনে যে শব্দগুলো সবচেয়ে বেশি শুনেছি তার একটা তালিকা করা যাক।
১. স্যরি
২. এক্সকিউজ মি
৩. থ্যাংক ইউ
ব্রিটিশদের আদব কেতার নানা গল্প শুনেছি। সেসব যে শুধু গল্প নয় তাতো এখন দেখছিই। ধরুন আমার ভুল, আমিই টিউবে ওঠার চলন্ত সিঁড়ি না বুঝে বাম পাশে দাঁড়িয়ে ব্লক করে দিয়েছি (এখানে ডান পাশে দাঁড়িয়ে বাম পাশটা ফাঁকা রাখতে হয়)। কিন্তু আমাকেই টপকে যাবার সময় কতবার যে 'স্যরি' আর 'এক্সকিউজ মি' বললো হিসেব করা দায়।
বহুবার এমন হয়েছে, কোন ভুল না করেও ভদ্রতাবশত বারবার 'স্যরি' বলছে কেউ। আরেকটা মজার ব্যাপারও আছে, কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু চোখে চোখ পড়লে হাসি না দিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় না কেউ। আর লিফটে উঠলে কুশল বিনিময়ও করছে।
এই যে এতসব ভদ্রতা বা আদব কায়দার কথা বললাম, এগুলো যদি দ্বিগুণ হয় তাহলে কি দাঁড়াবে ভাবুন! ঠিক সেই অভিজ্ঞতাই আমাদের প্রতিনিয়ত হচ্ছে বিশ্বকাপের ভেন্যুগুলোতে।
যেকোন বড় ক্রীড়া আসরের প্রাণ বা মুখ যেটাই বলি না কেন সেটা হল ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক। এখানেও ব্যতিক্রম নয়। তবে যেটা চোখে পড়ার মতো তা হল বিভিন্ন বয়সের স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন এখানে। অনেকেই অবসর জীবন ভেঙে এসেছেন। আর ভদ্রতা আর হাসিতে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতা যেন তাঁদের মধ্যে।
নীল জ্যাকেটের পেছনে উপরের লাইনে লেখা 'স্টাম্পড অথবা আউট! কাম টু আস'। অর্থাৎ সকল সম্যার সমাধান তাঁদের কাছে। এমনকি আপনার যদি সমস্যা না-ও থাকে তাও এসে হাসিমুখে দুহাত পেছনে রেখে জিজ্ঞেস করবে, সব ঠিক আছে তো স্যার?
হ্যারি, জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী হলেও খেলার টানে অস্ট্রেলিয়া থেকে ছুটে এসেছেন ওভালে বিশ্বকাপের ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করতে।
বিবিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন ক্রিস্টিনা। কিন্তু নিজ শহরে যখন বিশ্বকাপ এই ষাটোর্ধ্ব বয়সেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠ।
বিশ্বকাপের ১০ শহর আর ১১ ভেন্যু মিলিয়ে কাজ করছেন ৪ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। কয়েক ধাপের প্রক্রিয়া পেরিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১২তম আসরে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা।
স্টেডিয়ামের গেট, খেলোয়াড়দের অনুশীলন, প্রেসবক্স, সংবাদ সম্মেলন, কোথায় নেই তাঁরা! যার যে দায়িত্ব সেখান থেকে নড়চড় নেই একটুও। তবে আপনি যদি কোন জায়গা চিনতে অসুবিধা হয়, তাহলে হাতে ধরে নিয়ে যাবে আপনাকে। বৃষ্টি হলে মাথায় ছাতাও এগিয়ে দিতেও দেখেছি।
ব্রিটিশরা পুরো জাতিটাই খুব সুশৃঙ্খল। এই যে ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে হাজার বিশেক করে মানুষ হচ্ছে। কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। তাঁদের সাথে বাংলাদেশীরাও এক লাইন দিয়ে ঢুকছেন। স্টেডিয়াম জুড়ে কত খাবারের দোকান, সবাই লাইন দিয়ে কিনছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে খাচ্ছে, কিন্তু খাবারের বর্জ্য চোখে পড়বে না কোথাও। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলছে, প্রয়োজনে হাতে করে অনেক দূর বয়ে নিয়ে যেতেও আপত্তি নেই তাঁদের।
সিগারেট খাবেন? কোন সমস্যা নেই, নির্দিষ্ট স্মোকিং জোনে চলে যান।
যেই দেশের যে রীতি। এখানে থাকতে থাকতে এসব তাই চলে আসছে নিজের মাঝেও। কিংবা রপ্ত করার চেষ্টাও করছি বলতে পারেন।
হোটেলে, রাস্তায় বা দোকানে যে কারো সাথে কথা বলতে গেলেই দেখি মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হচ্ছে 'এক্সকিউজ মি'। আর কথা শেষ হবার পর এমনিতেই বেরিয়ে আসছে 'থ্যাংক ইউ' শব্দটা।
একদিনের অভিজ্ঞতা বলি। ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে বাঙালি অভ্যাসবশত থুথু ফেলেছিলাম। অনেক দূর থেকে সেটা দেখে এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে এরপর থেকে আমি থুথু ফেলাই ভুলে গিয়েছি। পরে খেয়াল করে দেখলাম এদেশে কেউই সেটা করেনা!