প্রধানমন্ত্রী যেই হোন, পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে মোটেও সেনাবাহিনীর খবরদারি কমার সম্ভাবনা নেই
স্বাধীনতার পর থেকে যে ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের বুকে তার কোনও পরিবর্তন এখনই হচ্ছে না। অন্তত তেমনটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী।
স্বাধীনতার পর থেকে যে ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের বুকে তার কোনও পরিবর্তন এখনই হচ্ছে না। অন্তত তেমনটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রের মাথায় বসতে গেলে যে সেনাবাহিনী হাতে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে প্রাক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়।
এই মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনা সেদেশের শাসনযন্ত্রে কতটা প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি সওকত আজিজ সিদ্দিকির বয়ানে। সওকতের অভিযোগ, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই যা আবার সেনাবাহিনীরই একটা উইয়িং পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধানবিচারপতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
সওকতের অভিযোগ, নওয়াজ যাতে দ্রুত জেলের বাইরে না আসতে পারেন তার জন্য প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দিয়েছিল আইএসআই। যে ভাবেই হোক নওয়াজ শরিফকে ২৫ জুলাই নির্বাচনের দিন পর্যন্ত জেলে আটকে রাখারও নির্দেস দেওয়া হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে সেনাবাহিনীর খবরদারি করাটা কোনও নতুন ইতিহাস নয়। স্বাধীনতার পরই পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা দেশের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভর করতেন। এমনকী, দেশ চালানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে সরাসরি মতামতও চাওয়া হত। রাজনীতির এই ফাঁক ধরেই সেনাবাহিনী পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে তার প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যার জন্য জেনারেল আয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কও হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের জেরে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের কি হাল হতে পারে তা প্রথম অনুধাবন করেছিলেন জুলফিকার ভুট্টো। তাই পাক সেনাবাহিনীকে শাসনযন্ত্রের বাইরে রাখতে তিনি তৎপর হয়েছিলেন। এর জন্য কড়া মূল্য চোকাতে হয়েছিল জুলফিকারকে। ক্ষমতা থেকে যেমন তাঁকে সেনাবাহিনী উৎখাত করে তেমনি জেলে পুড়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউল হক। সেই একই কাহিনি। জিয়ার পরে সেনাবাহিনী থেকে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসেছিলেন পারভেজ মুশারফ। কার্গিল যুদ্ধের সময় পারভেজ মুশারফ ছিলেন সেনা প্রধান। কিন্তু কার্গিল যুদ্ধে তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট মুশারফ সেনাদের নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন। নওয়াজকে যেতে হয়েছিল নির্বাসনে। আর পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছিলেন মুশারফ।
পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে মুশারফের এই জবরদখল জনতা সহজ মনে নেয়নি। মুশারফের বিরুদ্ধে এখন দুর্নীতির মামলা চলছে শুধু নয়, তিনি গত কয়েক বছর ধরে লন্ডনে গা ঢাকা দিয়ে বাস করছেন। তাই পাক সেনাবাহিনীর বর্তমান কর্তারা সরাসরি আর ক্ষমতা দখলের পথে হাঁটতে রাজি নন। বরং ঐতিহ্য বজায় রেখেই তাঁরা পাকিস্তানে সমান্তরাল সরকার চালাতে আগ্রহী। এতে জনতার দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ রাখাও সহজ হবে, আন্তর্জাতিক মহলের বিরূপ অবস্থান থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। সেইসঙ্গে পাক সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণও থাকবে।
নওয়াজ বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে এই আধিপত্যে অসুবিধা তৈরি হচ্ছিল। তাই পরিকল্পিতভাবেই নওয়াজকে দুর্নীতি মামলায় ফাঁসিয়ে তাঁর দলকে ব্যাকফুটে ঠেলেছে সেনাবাহিনী ও আইএসআই। এখন সেনাবাহিনী চাইছে তাঁদের এক পুতুল প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শীর্ষে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসা ইমরান খান তাই সেনাবাহিনীর অটোমেটিক চয়েস। কারণ, ইমরান তাঁর দলের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনও নীতি বা আদর্শের দর্শনকে আমদানি করতে পারেননি। তাঁর দলের একটাই ভিত্তি বিরোধিতা। সরকারে যেই থাক সুযোগ বুঝে তাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে যাওয়া। আর তাঁর আক্রমণের শিকারের গায়ে যদি লেগে থাকে ভারত বন্ধুর তকমা তাহলে তো কথাই নেই। সেনাবাহিনী তাই প্রধানমন্ত্রী পদে ইমরানকে আনতেই চাইছে। তাঁকে জেতাতে উঠে-পড়ে লেগেছে। কিন্তু জনতা জনার্দনের রায় কোথাও না কোথাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সেই হাওয়াকে ইমরানের দিকে ঘোরাতেও তৎপর হয়ে উঠেছে পাক সেনাবাহিনী।