অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র দেখে বন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা
বাংলাদেশে তিন কিশোর রোলার স্কেট নিয়ে ঝগড়ার জেরে তাদের এক খেলার সাথীকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে তাকে গুরুতর জখম করেছে। পুলিশ বলছে, টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র দেখে তারা এমন পরিকল্পনা করেছে।
বাংলাদেশে তিন কিশোর রোলার স্কেট নিয়ে বিবাদের জেরে তাদের এক খেলার সাথীকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে তাকে গুরুতরভাবে জখম করেছে। পুলিশ বলছে, ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র দেখে তারা এমন পরিকল্পনা করেছে।
পাবনার ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ ফিরোজ কবির জানিয়েছেন, ১৫ তারিখ রবিবার ঘটনাটি ঘটেছে।
যেভাবে ঘটেছে
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, চারটি কিশোর ছেলে একসাথে খেলাধুলা করতো। তাদের একজনের নাম আরাফাত। তার রোলার স্কেট অন্য তিন বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কিশোরটি কিনতে চেয়েছিল।
রোলার স্কেটটি তাকে দেয়াও হয়েছে কিন্তু বিনিময়ে কোন টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ওই কিশোর। তখন টাকার বদলে দুটো কবুতর চেয়েছিল আরাফাত।
মি. কবির বলেছেন, "কিন্তু টাকা বা কবুতর কিছুই না দিয়ে আরাফাতকে আখ ক্ষেতে নিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে তাকে মারাত্মকভাবে জখম করেছে তিন বন্ধু।"
তিন বন্ধুর বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। যাকে মেরে গুরুতর জখম করা হয়েছে সেই আরাফাতের বয়স ১২ বছর।
মোঃ ফিরোজ কবির বলছেন, "এই ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সে জানিয়েছে সে নিয়মিত ভারতীয় চ্যানেলে 'ক্রাইম পেট্রল' নামে একটা অনুষ্ঠান দেখত। সে বলেছে, সেখান থেকেই সে জেনেছে কী করতে হয়।"
তিনি বলছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী আখ ক্ষেতে রড লুকিয়ে রাখা ছিল। সেখান থেকে আখ তুলে খাওয়ার কথা বলে আরাফাত নামের বন্ধুটিকে তারা নিয়ে যায়। আখ তুলতে মাটির দিকে ঝুঁকতে বলে, তার পর পেছন থেকে লোহার রড দিয়ে পেটাতে আরম্ভ করে।
"আরাফাত জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তারা ধরে নেয় সে মারা গেছে এবং সেই অবস্থায় তাকে সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আরাফাত চিৎকার করে উঠলে তারা আবার ফিরে এসে তাকে মারে এবং আবার মৃত মনে করে চলে যায়। সেখানেই রক্তাক্ত অবস্থায় ১২ ঘণ্টা পড়েছিলো আরাফাত।"
আরো পড়ুন:
গেমে আসক্তি 'মানসিক রোগ', বাংলাদেশের চিত্র কি?
কেন আড়ালে থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশে ছেলে শিশুদের উপর চালানো যৌন নির্যাতন?
যেভাবে গড়ে ওঠে দুর্ধর্ষ কিশোর অপরাধীদের দল
তিনি জানিয়েছেন, ওই তিন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল তাদের কিশোর আদালতে তোলা হয়েছিলো। মামলা চলাকালীন থানা হাজত থেকে তাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।
আর মার খেয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আরাফাত এখন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় রয়েছে।
অনুষ্ঠান কিভাবে প্রভাবিত করে?
বিশ্বব্যাপী অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র ব্যাপক জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও ভারতীয় টেলিভিশনের এমন কয়েকটি অনুষ্ঠানের প্রচুর দর্শক রয়েছে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ইদানীং এমন অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র তৈরি করছে।
এসব অনুষ্ঠানে বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া খুন বা অপহরণের মতো অপরাধকে অভিনয় ও উপস্থাপকের বর্ণনার মাধ্যমে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
পুলিশ, ঘটনার সাক্ষী, পরিবার, ঘটনার শিকার ব্যক্তি- এরকম বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলে গবেষণা করা হয় এবং ঘটনা যেভাবে ঘটেছে সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক উম্মে ওয়ারা বলছেন, "এমন একটা গল্প দেখানো হচ্ছে যেখানে খুব সাধারণ একটা মানুষ খুন করার পরিকল্পনা করছে।"
"ধরুন দেখানো হচ্ছে কিভাবে খুন করতে হবে, কিভাবে তার শরীর কেটে টুকরো টুকরো করতে হবে, তারপর কিভাবে ফ্রিজে রাখতে হবে বা বডি লুকাতে হবে। অপরাধ প্রবণতা আমাদের সবার মধ্যে কম বেশি থাকে। এসব অনুষ্ঠান সেটাকে অনেকের মধ্যে বাড়িয়ে দেয়।"
তিনি বলছেন, শিশুদের মনে এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে কিশোরদের উপর।
তার মতে, "এর একটি কারণ কিশোর বয়সে ভালোমন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকে না। তারা এগুলোকে উত্তেজনাকর বলে মনে করে। তাদের মধ্যে হিরোইজমের একটা ধারনা কাজ করে। বিখ্যাত ও কুখ্যাত এই দুটি বিষয়ের পার্থক্য তারা বোঝে না।"
এমন অনুষ্ঠান কি অপরাধকে স্বাভাবিক করে তোলে?
বেশিরভাগ সময় এই অনুষ্ঠানগুলোতে অপরাধ দমন সম্পর্কে কোন বার্তা থাকে না বরং অপরাধ সংগঠনের বিষয়টি বিস্তারিত দেখানো হয়।
শুধুমাত্র অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র নয়, সিনেমা এবং ভিডিও গেমসগুলোতেও অনেক সহিংসতা দেখানো হয়।
ভিডিও গেমসে সরাসরি অংশগ্রহণেও এক ধরনের স্বাদ পাওয়া যায়। কিশোর ও তরুণদের মধ্যে এসব গেমস অনেক জনপ্রিয়।
ক্লিনিকাল সাইকোলজিষ্ট ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, "এসব অনুষ্ঠান বা সিনেমার অপরাধীরা কিশোর বয়সী অনেকের কাছে ফ্যান্টাসি চরিত্রে পরিণত হয়। নিজের অজান্তেই তাদের বৈশিষ্ট্য সে ধারণ করতে শুরু করে।"
তার মতে, "এসব অনুষ্ঠানে অপরাধকে এমনভাবে দেখানো হয় যে সমাজে এগুলো ঘটেই থাকে, এগুলো খুব স্বাভাবিক এমন একটা বার্তা তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, ধরুন ভিডিও গেমসে শত্রুর সাথে লড়াই করা, তাকে মেরে ফেলা এগুলো তাদের মধ্যে একটা কল্পনার জগত তৈরি করছে।"
"অনেক সময় দেখা যায়, বাস্তব জীবনের কোন ঘটনাকে ওই কল্পনার জগতের মতো করে তারা সামাল দেয়ার চেষ্টা করে।"
উম্মে ওয়ারা মনে করেন, অপরাধ বিষয়ক তথ্যচিত্র, অ্যকশনধর্মী সিনেমা অনেক সময় অপরাধ ও সহিংসতাকে 'মহিমান্বিত' করে। অপরাধ ও সহিংসতাকে এক ধরনের স্বাভাবিকতা দেয়।
বাবা মায়েরা যা করবেন
পশ্চিমা বিশ্বে শিশুরা টেলিভিশনে এমন অনুষ্ঠান যাতে দেখতে না পারেন সেজন্য টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে "প্যারেন্টাল লক" বলে এক ধরনের ব্যবস্থা থাকে।
সিনেমা হলে কোনটি কোন বয়সের সিনেমা, কোন সিনেমা দেখতে কত বছর বয়সীরা ঢুকতে পারবেন সে বিষয়েও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা-মায়ের সাথে বসেই শিশু কিশোরেরা অপরাধ ও সহিংসতা আছে এরকম অনুষ্ঠান দেখছে।
ডা. ইশরাত শারমিন রহমান বলছেন, "সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে, অভিভাবকদেরকে আগে এসব অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ করতে হবে। যেটা আমি নিজে করবো সেটি বাচ্চাদের নিষেধ করলে কাজ হবে না।"
তিনি বলেছেন, শিশুদের জন্য খেলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে, যাতে তাদের আগ্রহ পরিবর্তিত হয়।
মাঠ না থাকলে ঘরে যেসব খেলা যায় সেগুলো ব্যবস্থা করার কথা বলছেন তিনি। "হাতে মোবাইল ও টিভির রিমোট দিলেই হবে না, তাকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে যে সে কী দেখছে।"
তবে তিনি বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন শিশুদের সাথে অভিভাবকদের নিয়মিত কথা বলার বিষয়ে, শিশু কিশোরদের কথা শোনার ব্যাপারে।
তিনি বলছেন, "শিশুরা কিছু বললে রেগে গিয়ে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং তাদেরকে অপরাধের ফল কি হয় সেটি বোঝাতে হবে। পাশাপাশি তাদের শেখাতে হবে কনফ্লিক্ট রেজুলুশন। অর্থাৎ পাশাপাশি চলতে গেলে অনেকের সাথে অনেক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে, যা মেটাতে কাউকে আঘাত করা সমাধান নয়।"
অন্যান্য খবর:
বিতর্কিত 'রাজাকারের তালিকা' স্থগিত করলো সরকার
অটোমেশন হলে গার্মেন্টে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বাড়বে?
নাগরিকত্ব আইন: আসামে 'তিনকোনিয়া বিভাজন'