করোনা ভাইরাস প্রকোপের জের, মা–বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন করিয়ে শিশুদের চিকিৎসা হংকং হাসপাতালে
করোনা ভাইরাস প্রকোপের জের, মা–বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন করিয়ে শিশুদের চিকিৎসা হংকং হাসপাতালে
গোটা বিশ্ব যখন তৃতীয় করোনার ওয়েভের আতঙ্ক কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে ঠিক সেই সময় হংকং–এ অন্য ছবি ধরা পড়েছে। এই দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে এই দেশের সরকার হয়ত লকডাউনের পথে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই হংকংয়ে যে সব শিশুরা ও সন্তানেরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মা–বাবার থেকে আলাদা করে রাখা হচ্ছে। করোনার জন্য আর্থিক কেন্দ্রে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব দেখা দেওয়ার ফলে তা সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছে।
হংকংয়ে বাড়ছে করোনার প্রকোপ
ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটি জোরদার করোনা ভাইরাসের কবলে পড়েছে, প্রতিদিন হাজার জন করে করোনা রোগীর কেস নথিভুক্ত হওয়ার দরুণ হাসপাতাল ও আইসোলেশন ইউনিটেও জায়গার অভাব দেখা দিয়েছে। চিনের মতো কড়া জিরো-কোভিড নীতি এই ভাইরাসটিকে গত দু'বছরে এই দেশে সেভাবে আছড়ে পড়তে দেখা যায়নি। হংকং-এ ডিসেম্বরের শেষের দিকে ওমিক্রন সংক্রমণের প্রথম খোঁজ মেলে। তার পর থেকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকতে করোনা ভাইরাসের এই রূপ। শুক্রবার পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন ওমিক্রনে। এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে মাত্র দু'মাসের মধ্যে। গত দু'টি কোভিড ওয়েভে হংকং-এ মোট ১২ হাজার জন আক্রান্ত হয়েছেন। এই ওমিক্রনের কারণেই এই দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো একেবারে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় চলে গিয়েছে।
জিরো–কোভিড নীতি
চিনের পক্ষ থেকে হংকংকে কড়া জিরো-কোভিড নীতি মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং লক্ষ্য এটাই ছিল যে কারোর টেস্ট পজিটিভ হলে তাকে আইসোলেট করা হবে, যদিও দৈনিক মামলা এতটাই বেড়েছে যে তা ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। কিছু কিছু অভিভাবক তাদের শিশুদের সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছে আবার অনেক মা-বাবা অসুস্থ সন্তান ও শিশুদের থেকে তাদের আলাদা করে দেওয়ার আতঙ্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছেন। কোভিডের এই প্রকোপ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে।
শিশুর অভিভাবকরা থাকতে পারছেন না হাসপাতালে
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সিদ্ধার্থ শ্রীধর টুইটারে বলেছেন, ‘কোভিডের জন্য যদি শিশুকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে, তবে একটা ঘরে একজন অভিভাবকের থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে নয়তো শিশুর পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়ে যাবে।' তিনি এও বলেন, ‘এইরকম সময়ে, যুক্তিবাদী এবং সহানুভূতিশীল থাকা আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ'। ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ৩২ বছরের লরা জানিয়েছেন যে তাঁর মেয়ে আভার করোনা পজিটিভ ধরা পড়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় রবিবার রাতে। তার জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা গিয়েছিল। লরা জানিয়েছেন যে তিনি হাসপাতালের মাটিতে শুয়েছিলেন। আইসিইউতে আভার স্বাস্থ্য এখন স্থিতিশীল এবং তাকে শীঘ্রই আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হবে যেখানে তাকে কমপক্ষে সাতদিন মা-বাবা ছাড়াই সুস্থ হতে হবে। লরা চোখে জল নিয়ে বলেন, ‘আমি বলেছিলাম আমি করিডরের মেঝেতে শুয়ে পড়ব, যেখানে খুশি।' তবে মঙ্গলবার লরা ও তাঁর স্বামী ভিডিও কল করে তাদের মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন।
চিকিৎসার জন্য সন্তানকে রাখতে হচ্ছে হাসপাতালে
লরা বলেন এটা খুবই খারাপ বিষয়। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে মাত্র ১১ মাসের, সে তার আশপাশে কি চলছে বুঝতে পারছে, বিচ্ছেদের আতঙ্কএই বয়সে সবচেয়ে বেশি থাকে, সে অসহায় ছিল, শুধু মা মা বলে কেঁদে চলেছে।' অনলাইনে অভিভাবকদের গোষ্ঠী এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তাদের রাগ, ক্ষোভ, বিভ্রান্তি উগরে দিয়েছে। জনপ্রিয় ফেসবুক সহায়তা গোষ্ঠীর প্রশাসক কুঞ্জ গান্ধী জানিয়েছেন যে অনেক হাসপাতালে ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার কারণে তারা অভিভাবকদের সেখানে থাকতে অনুমতি দিচ্ছে না। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অনেকেই (অভিভাবক) লড়াই করার বা যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সন্তানকে হাসপাতালে রেখে যাওয়ার হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল যাতে শিশুটি তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে পারে।'
ফেসবুকে সোচ্চার অভিভাবকেরা
বেশিরভাগ ক্যান্টোনিস ভাষী ১৭ হাজার মায়েরা ফেসবুক গ্রুপে করোনা ভাইরাস চিকিৎসার জন্য বলেছিলেন, অনেকেই জানিয়েছিলেন যে হাসপাতালে তাদের অসুস্থ সন্তান রয়েছে কিন্তু হাসপাতালে যেতে তারা ভয় পাচ্ছে। একজন অভিভাবক লিখেছেন, ‘আমার ছেলে আড়াই বছর বয়স এবং সোমবার সকাল থেকে তার জ্বর।' আরও এক মা লেখেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না কি করব, আমি খুব ভয় পেয়ে রয়েছি।' অন্যরা লিখেছেন যে স্বাস্থ্য বিভাগ এবং সরকারী পরামর্শ লাইনে ফোন করা হলে সেখান থেকে উত্তর দেওয়া হয়নি।
কি বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
হংকং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাউ কা-হিন নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে শিশুদের অভিভাবকদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম যে কোভিডে আক্রান্ত শিশু ও তার অভিভাবকেরা যাতে একই হাসপাতালে থাকতে পারে যাতে অভিভাবকরা সন্তানদের যত্ন নিতে পারে।' তিনি বলেন, ‘কিন্তু হাসপাতালগুলিতে এত করোনা কেস এসেছে এবং অনেক শিশুও আক্রান্ত, তাই আমাদের কর্মীদের সময় লাগছে তাদের জন্য ঠিকঠাকভাবে বন্দোবস্ত করার।'
কেন বাড়ছে হাসপাতালে ভিড়
ডিসেম্বর মাসে ওমিক্রন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়ার পর থেকে প্রশাসন দ্রুত কড়া কোভিড বিধি জারি করে। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় উড়ানে। বিধি-নিষেধ জারি করা হয় জমায়েত-অনুষ্ঠানে। কিন্তু তাতেও সংক্রমণকে কামানো যায়নি। ওমিক্রন আক্রান্তরা ভিড় করছেন হাসপাতালের দরজায়। কোভিডের মৃদু উপসর্গ দেখা দিলেন তারা পৌঁছে যাচ্ছেন হাসপাতালে। তার পেছনেও দায়ি দেশের সরকার। প্রথম করোনা ওয়েভের পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে মৃদু উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হবে। আর সেই কারণে বর্তমানে হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা হাসপাতাল তৈরির।