করোনাভাইরাস: প্রতিষেধক তৈরির ব্যাপারে কতদূর বিজ্ঞানীরা
করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির জন্য নিরবচ্ছিন্ন কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। গত ১১ই জানুয়ারি শুরু হয় প্রতিষেধক তৈরির কাজ। কবে তা শেষ হবে? কবে ব্যবহার করতে পারবে মানুষ?
নতুন একটি ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এই রোগের কোনো আরোগ্য নেই, নেই কোনো প্রতিষেধক।
এর আগে অনেকবার এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে বিশ্ব।
শুধু গত পাঁচ বছরেই বিশ্বে ইবোলা, জিকা, মার্স (মিডল ইসট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নামের আরেক ধরণের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।
এখন '২০১৯ এনকভ' নামের ভাইরাসের সংক্রমণ শঙ্কায় ফেলেছে সারা বিশ্বকে।
এরই মধ্যে এই ভাইরাসে হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছে এবং ১৭০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে।
আগের রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাগুলোর সাথে যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যায় যে সেসব ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে বিজ্ঞানীদের কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল। তবে এবার ভাইরাসটি চিহ্নিত করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ানো বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের গবেষণা শুরু হয়।
চীনের কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত এই ভাইরাসের জেনেটিক কোড জানিয়ে দেয়। এর ফলে বিজ্ঞানীরা সহজে একটি ধারণা তৈরি করতে পারেন যে এই ভাইরাসটি কোথা থেকে এসেছে, ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এটির প্রকোপ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এই ভাইরাস থেকে মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গবেষণায় অর্থায়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের দ্রুত উদ্যোগের ফলে দ্রুততার সাথে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয়েছে।
https://www.youtube.com/watch?v=Kof_dVnzM7s
আরো পড়তে পারেন:
করোনাভাইরাস: লক্ষণ, প্রতিরোধ ও আরো দশটি তথ্য
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি কোথায়, কেন এতো প্রাণঘাতী
করোনাভাইরাস: বিশ্ব কি জরুরি অবস্থা জারির দ্বারপ্রান্তে?
করোনাভাইরাস: বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে ভাইরাসের মতোই
কীভাবে এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস
চীনের ভাইরাস আক্রান্ত উহানের একাত্মতার গল্প
প্রতিষেধক তৈরিতে অভূতপূর্ব দ্রুততা
স্যান ডিয়েগোর ইনোভিয়ো'স ল্যাবরেটরিতে সম্ভাব্য প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানীরা অপেক্ষাকৃত নতুন ধরণের ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।
প্রতিষেধকটিকে এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে 'আইএনও-৪৮০০', যেটি এই গ্রীষ্মে মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইনোভিও'র গবেষণা বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কেট ব্রোডেরিক বলেন: "চীন এই ভাইরাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স জানানোর পর আমরা ল্যাবের কম্পিউটারে প্রবেশ করাই এবং তিন ঘন্টার মধ্যে একটি প্রতিষেধক ডিজাইন করি।"
"আমাদের প্রতিষেধক ভাইরাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স ব্যবহার করে মানবদেহে থাকা ভাইরাসের বিশেষ কিছু অংশে আঘাত করে এবং আমাদের বিশ্বাস দেহ তখন ঐ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হবে।"
ইনোভিও বলছে প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের দেহে চালানো পরীক্ষাগুলো যদি সফল হয়, তাহলে আরো বড় পরিসরে পরীক্ষা চালানো হবে।
আর ঐ পরীক্ষাটি 'এ বছরের শেষভাগে' চীনের ভাইরাস আক্রান্ত এলাকায় পরিচালনার পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি।
ভাইরাস সংক্রমণ ঐ সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
কিন্তু ইনোভিওর পরিকল্পনা যদি সফল হয়, তাহলে এরকম রোগ ছড়ানোর পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দ্রুতবেগে সফলভাবে প্রতিষেধক তৈরির নজির স্থাপিত হবে।
এই ধরনের একটি ভাইরাস - ২০০২ সালে সার্স - শেষবার যখন চীনে ছড়িয়ে পড়ে, তখন চীনের কর্তৃপক্ষ অনেকদিন পর ঐ রোগের সংক্রমণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করে। তাই যে সময় প্রতিষেধক তৈরির কাজ শুরু হয়, ততদিনে ভাইরাস সংক্রমণ প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
২০১৯-এনকভ এর টাইমলাইন
- ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ - উহানে অস্বাভাবিক হারে নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অবহিত করে চীন।
- ১লা জানুয়ারি ২০২০ - যেই সামুদ্রিক খাদ্য ও প্রাণীর বাজারকে মনে করা হয়েছিল সংক্রমণের কেন্দ্র, সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
- ৯ই জানুয়ারি ২০২০ - বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায় নতুন ধরণের করোনাভাইরাসের কারনে সংক্রমণ ঘটছে।
- ১০ই জানুয়ারি ২০২০ - নতুন ভাইরাসের জিনেটিক কোড জানায় চীন
- ১১ই জানুয়ারি ২০২০ - বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক তৈরিতে কাজ শুরু করেন - এই ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
- ১৩ই জানুয়ারি ২০২০ - প্রথমবারের মত ভাইরাস চীনের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন দেশের সরকার এবং মানবতাবাদী সংগঠনের অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থা কোয়ালিশন অব এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সেপি) নামের একটি সংস্থা প্রতিষেধক তৈরিতে নিয়োজিত গবেষণাগারগুলোর অর্থায়ণ করছে।
পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর নতুন ধরণের রোগের প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যে এই সংস্থা তৈরি করা হয়।
এই সংস্থার প্রতিষেধক গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ডক্টর মেলানি স্যাভিল বলেন, "রোগ ছড়িয়ে পড়া যেন মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরুপ না হয় তা নিশ্চিত করা এবং নতুন ধরণের রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে কাজ করাই এই সংস্থার উদ্দেশ্য।"
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা
এই নতুন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে কাজ করছে, এমন আরো দু'টি প্রকল্পে কাজ করছে সংস্থাটি।
একটি 'মলিকিউলার ক্ল্যাম্প' প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যে কাজ করছে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি 'শরীরকে একাধিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিষেধক তৈরি করতে সাহায্য করে।'
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ বিষয়ক জাতীয় সংস্থার সাথে ম্যাসাচুসেটসের মডার্না ইনকর্পোরেশন যুক্ত হয়ে প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যে গবেষণা করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন প্রতিষেধকের বৈশ্বিক প্রয়াসের সমন্বয় করছে। তারা জানিয়েছে, সেপি'র অর্থায়নে পরিচালিত তিনটি গবেষণা প্রকল্প ছাড়াও অন্যান্য সংস্থাগুলোর গবেষণাগুলোর ওপরও নজর রাখছে তারা।
নতুন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির প্রচেষ্টা বেশ জোরেসোরে চললেও গবেষণা এখনও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ ধরণের রোগের প্রতিষেধক তৈরির জন্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল বেশ সময়সাপেক্ষ এবং সবচেয়ে কার্যকরভাবে চালানো সম্ভব হয় যখন রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, ঐ সময়ে।
বর্তমানে গবেষণাগারগুলোতে তৈরি করা প্রতিষেধকগুলো যে চীনে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি প্রোগ্রাম বিভাগের আনা মারিয়া হেনাও-রেস্টরেপো বলেন: "আমার একটা কাঠামো তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কাদের তৈরি করা প্রতিষেধক সবার আগে ব্যবহার করা হবে।"
"বিশেষজ্ঞরা তৈরি করা প্রতিষেধকগুলোর গ্রহণযোগ্য নিরাপত্তা মাত্রা, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার যথাযথ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিষেধকের পর্যাপ্ত যোগানের মত বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।"
মানুষের ওপর কোন প্রতিষেধক পরীক্ষা করা হবে তা কিছুদিনের মধ্যে নিশ্চিত করবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।