থোড় বড়ি খাড়া, ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যেভাবে ১-০ গোলে কংগ্রেসকে হারাল গান্ধী পরিবার
শুধু নেতৃত্বের অভাব নয়, তা ছাড়াও কংগ্রেসের অন্দরে বর্তমানে রয়েছে একাধিক সমস্যা। সেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তা মেটানোর লক্ষ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল গতকালের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। তবে সমাধান খোঁজার চ্যালেঞ্জে পাশ মার্কস কি কংগ্রেস পেল? বহুলচর্চিত আলোচনাসভা ঘিরে আগ্রহ চড়ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তার ফল হল সেই থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।
যেই কারণে ডাকা হয়েছিল ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক
দলের ২৩ জন শীর্ষ নেতার উত্থাপন করা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। এই নেতারা পূর্ণ মেয়াদের জন্য সভাপতি নিয়োগ নিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং দলের আগাগোড়া সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে সনিয়া গান্ধীর কাছে জুলাই মাসে চিঠি লিখেছিলেন।
'ফুল টাইম' প্রধানের দাবি
একদিকে সনিয়ার অসুস্থতা আর অন্যদিকে গত ১০ অগাস্ট তাঁর কংগ্রেসের অন্তবর্তীকালীন প্রধান হিসাবে এক বছরের মেয়াদ পূর্ণ করা। ফলে এবার ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য দলের তরফে 'ফুল টাইম' প্রধানের দরকার অত্যন্ত বেশি। অথচ এত কিছু সত্ত্বেও ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক আদপে চিহ্নিত হয়ে রইল দলের প্রবীণ ব্রিগেড এবং রাহুলপন্থী নেতাদের মধ্যের বাহুবল প্রদর্শন হিসাবে। বিশেষ করে প্রবীণ নেতাদের এই বৈঠকে নিজেদের মতামত তুলে ধরার চেষ্টাতেই অনড় থাকতে দেখা গেল।
গুলাম-সিব্বলদের আক্রমণ রাহুলের
দলে তাঁর মতাদর্শের বিরোধীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাহুল মন্তব্য করেছিলেন যে, আদপে এই নেতারা বিজেপির হয়ে কাজ করছেন। রাহুলের এই উক্তি সংবাদমাধ্যমে বহুল চর্চিত হয় এবং এতে দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়। ভাবমূর্তি উদ্ধারের জন্য নেমে দ্রুত দল সেই মন্তব্যের সত্যতা অস্বীকার করে। তার পাশাপাশি কংগ্রেসের মুখরক্ষা করে স্বয়ং রাহুল গান্ধীর নিজে থেকে প্রবীণ নেতা কপিল সিব্বলকে ফোন করে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামা।
ক্ষুব্ধ হন সিব্বল-আজাদ
সিব্বল ওয়ার্কিম কমিটির বৈঠকে ছিলেন না। তবে সংবাদমাধ্যমে বহুলচর্চিত রাহুলের মন্তব্য সংক্রান্ত খবর নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। উত্তেজনা প্রশমিত করে সিব্বল তড়িঘড়ি একটি টুইটে নিজের অসন্তোষ জাহির করেন। তার পরই আরও এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা, গুলাম নবি আজাদও টুইট করে জানান, যদি তাঁর সঙ্গে বিজেপির যোগসূত্র প্রমাণিত হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
মনোক্ষুণ্ণ নেতাদের মান ভাঙানে রাহুল
আজাদ ও সিব্বলের প্রতিক্রিয়া (সনিয়ার কাছে লেখা চিঠিতেও এঁদের স্বাক্ষর ছিল) গান্ধীদের কাছে সিলভার লাইনিংয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ দুই বিক্ষুব্ধ নেতাই পের তাদের টুইট ডিলিট করে ভুল বোঝাবুঝির বিষয়টি মেনে নেন। আর এতে বোঝা গিয়েছিল, দলে মনোক্ষুণ্ণ নেতাদের মান ভাঙানোয় গান্ধীদের ক্যারিশমার এখনও জুড়ি মেলা ভার আর কেবল তাঁরাই পারেন দলকে একজোট করে রাখতে। তবে জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার লক্ষ্যে এগোনোর কোনও ইচ্ছা আপাতত নেই কংগ্রেসের।
সহকর্মীদের মন্তব্যে দুঃখিত সনিয়া
সনিয়া এই বলে বৈঠকে নিজের বক্তব্য শেষ করেন যে, তিনি দলে তাঁর সহকর্মীদের মন্তব্যে দুঃখ অবশ্যই পেয়েছেন এবং এটাও মানেন যে, তাঁর সঙ্গে মতাদর্শের পার্থক্য অনেকেরই রয়েছে ও থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলকে একজোট হয়েই থাকতে হবে। শেষে সকলে, গান্ধীরা যেমনভাবে চেয়েছিলেন, সেই খসড়া প্রস্তাবেই সই করেন।
দলে সংস্কারের জন্য যেন উদ্যোগ নেওয়ার দাবি
এদিকে যেই ২৩ জন নেতা চিঠি লিখেছিলেন, তাঁদের বক্তব্য, তাঁরা শুধু চান দল যেভাবে ক্রমাগত নানা দিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে, তার সমাধানে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং দলে সংস্কারের জন্য যেন উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা দলে প্রয়োজন অনুসারে যে কোনও বদলের জন্য সনিয়ার হাতেই সব দায়িত্ব তুলে দেন। রাহুলের সমর্থক নেতাদের জন্য মুখরক্ষার বিষয় ছিল, তাঁকেই ফের দলের সভাপতি পদে পরিগণিত করার দাবি তোলা। সেই রবেই সম্ভবত কোনও অ-গান্ধী নেতাকে প্রধান করার গুঞ্জন চাপা পড়ে যায়।
ঘুরে ফিরে সেই গান্ধীদের হাতেই কংগ্রেস
সনিয়ার পুরানো বিশ্বস্ত নেতা আহমেদ প্যাটেল রাহুলের কাছে আবেদন করেন, তিনি যেন দলে সোনিয়ার পদ গ্রহণ করেন। এই সংক্রান্ত বদলের সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে ঠিক হলেও মনে করা হচ্ছে, যেভাবে এর আগে আন্তঃনির্বাচনে রাহুল কংগ্রেস প্রধান হিসাবে মনোনীত হয়েছিলেন, যেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র প্রার্থী, এবারও সম্ভবত সেটাই হতে চলেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রাহুল কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নেন। কিন্তু ২০১৯ সালের মে মাসে সর্বভারতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তিনি পদত্যাগ করেন।
বিতর্ক কিছুটা হলেও ধামাচাপা দেওয়া গিয়েছে
আপাতত কংগ্রেসে নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক কিছুটা হলেও ধামাচাপা দেওয়া গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষে, দলের স্বার্থেই তাদের ২৩ জন 'বিরোধী'র প্রকাশ করা উদ্বেগ অবহেলা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আর সেই পথে চলতে গিয়েই মুখোমুখি হতে হবে চ্যালেঞ্জের। কারণ দলের তরফে নেতৃত্বের বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি তৈরি হওয়া সংকটকে গান্ধীদের বিরুদ্ধে চালানো আরও একটি প্রচারকৌশল বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। গান্ধীদের তরফে অবশ্য ক্ষমতা ধরে রাখার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে এবং দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে রীতিমতো হুঁশিয়ারি জারি করে অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য না করতে বলা হয়েছে।
বিদ্রোহের আগুনে পুড়বে 'হাত'! আজাদের বাড়িতে ৯ কংগ্রেস নেতার বৈঠক ঘিরে জোর জল্পনা