গেরুয়া ঝড়ে নিভে গেল ‘বহেনজি’র প্রদীপ, মায়াবতীর দলিত রাজনীতির বেহাল দশা কেন?
গেরুয়া ঝড়ে নিভে গেল ‘বহেনজি’র প্রদীপ, মায়াবতীর দলিত রাজনীতির বেহাল দশা কেন?
দেশের একমাত্র দলিত মহিলা মুখ্যমন্ত্রী, মায়াবতীকে এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে একটি মাত্র বিধায়ক নিয়ে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভায় সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির একমাত্র বিজয়ার নামও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি। সংখ্যার দিক থেকে এটি বিধানসভার সব দলের মধ্যে সবচেয়ে কম, এমনকী রাজা ভাইয়ার সদ্য চালু হওয়া জনসত্ত্বা দল লোকতান্ত্রিকের চেয়েও কম।
১৩–এর নীচে ভোট শতাংশ
উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের ফলাফলে দুপুর পর্যন্ত ট্রেন্ডে দেখা গিয়েছে, মাত্র দুটি আসনে এগিয়ে বসপা। ভোট শতাংশ ১৩-এর নীচে ১২.৮৪ শতাংশ। ১৯৯৩ সালে এর চেয়ে ভোট শতাংশ কম ছিল ১১.১২ শতাংশ। তার চেয়ে এবার একটু বেশি। ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচন এক কথায় উত্তরপ্রদেশে বসপার তেজকে খতম করেছে। সেই সঙ্গে মায়াবতী-ম্যাজিকও আর বোধহয় সেভাবে কাজ করবে না, যেখানে একসময় মায়াবতী ছাড়া বা মায়াবতী সহ বসপা ২০ শতাংশ ভোট শতাংশ নিয়ে আসতে সক্ষম ছিল।
একটি আসনে জয়ী বসপা
২০০৭ সালে যখন বসপা ২০৬ আসন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল, সেই সময় মায়াবতীর দলের ঝুলিতে ছিল ৩০.৪৩ শতাংশ ভোট। এমনকী ২০১২ সালেও বসপা ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং ২০১৭ সালেও বসপা-মায়াবতী ২২.৩৩ শতাংশ ভোট সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়, সেই সময় ১৯টি আসনে জয়ী হয়েছিল বসপা। কিন্তু ২০২২ সালে গেরুয়া ঝড়ে সব ওলট-পালট হয়ে গেল উত্তরপ্রদেশে। ২০২২-এর বিধানসভায় পূর্ব উত্তরপ্রদেশের বালিয়ার রসারায় একটি আসন পেয়েছে বসপা। এখানকার প্রার্থী উমা শঙ্কর সিং, এখানকার বসপা বিধায়ক, তিনি ২০১২ ও ২০১৭ সালে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বসপা প্রার্থী ৬ হাজার ভোটে জয়ী হন এই কেন্দ্রে। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় বিজেপির বি-পার্টি হওয়ার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন মায়াবতী এবং নিজের কম চমকপ্রদ প্রচারের ওপর তিনি আস্থা রেখেছিলেন। বসপার প্রচারে কোনও তারকা চমক ছিল না বিজেপির মতো, মায়াবতী মাত্র ২০টি জনসভা করেছিলেন।
বসপার ক্যারিশ্মা শেষ
নির্বাচনের সময় বিজেপির হাত ধরেছে বসপা, এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণ ছিল উত্তরপ্রদেশে প্রচারে এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ প্রচারের মাঝখানে মায়াবতীর অস্বাভাবিক প্রশংসা করা, এর সঙ্গে মায়াবতীর উদারতাকে স্বীকৃতি দেওয়া। তাঁর পছন্দের প্রার্থী, যার মধ্যে মুসলিম নেতারা রয়েছেন এমন আসনগুলিতে সমাজবাদী পার্টি একটিতে প্রার্থী দিয়েছিল, সেই সময় মায়াবতীকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য কি সপাকে পরাজিত করা। ঘটনাচক্রে বসপার ভোট ভাগ বিশাল শতাংশে কমে গেলেও, বসপা ও সপা উভয় দলের ভোট বাড়তে দেখা গিয়েছিল।
চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী
গৌতম বুদ্ধ নগরের বাদলপুর গ্রামের শিক্ষিকা থেকে রাজনীতিবিদ ৬৬ বছরের মায়াবতী, যাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে 'বহেনজি' বলে ডাকা হয়, প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন ১৯৯৫ সালে। কিন্তু কয়েক মাস টিকেছিল তাঁর সরকার। তার পরে বেশ কয়েকবার উত্তরপ্রদেশে কোনও দলই পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মায়াবতী। তাও আবার বিজেপির সাহায্যে। তার পর ২০১৭ সালে একার জোরেই পূর্ণ ক্ষমতায় বিধানসভায় জেতেন। চার বার মোট মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেন তিনি। ২০০৭ সালের নির্বাচনের ফলাফলে, বসপার জয়ের পেছনে দলিথদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। দলিতরা উজাড় করে ভোট দেন বসপাকে এবং ধরাশায়ী হয় সপা, যেটা ঐতিহাসিক জয় ছিল বসপার। এটাতে অবশ্যই কৃতিত্ব ছিল মায়াবতীর সফলতম স্লোগান, 'সর্বজন হিতায়া, সর্বজন সুখায়া (সকলের জন্য, সকলের ভালো থাকার জন্য)'। সামাজিক কল্যাণ, ব্রাহ্মণদেরও আকর্ষণ করেছিল বসপার নীতি।
বসপা ও মায়াবতীর স্বর্ণালী দিনগুলি
১৯৮৪ সালে বসপা গঠন হওয়ার পর রাজনৈতিক গুরু কাশী রাম দলের দায়িত্ব মায়াবতীর হাতে তুলে দেন, দলিতদের একত্রিত করার লক্ষ্য নিয়ে। সেটা ছিল মায়াবতীর কাছে স্বর্ণালী মুহূর্ত। বসপার কিছু সফলতম স্লোগানের মধ্যে একটি ছিল, 'গুণ্ডাদের বুকে চড়ে হাতিতে মোহর লাগাও।' বসপার চিহ্ন ছিল হাতি। ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল, 'পণ্ডিত শঙ্খ বাজাবে, হাতি এগিয়ে যাবে।' তবে মায়াবতীর বসপার শাসনকাল একাধিক বিতর্ক দ্বারা চিহ্নিত, বিশেষ করে দলিত আদর্শবাদী সহ নিজের মূর্তি তৈরি করা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছিল মায়াবতীকে। তবে মায়াবতীর শাসনকালেই যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্প তৈরি হয়েছিল। তবে এই প্রকল্প নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে কৃষদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল মায়াবতীকে।
মায়াবতীর কঠিন সময় শুরু
ক্ষমতা যখন চলে যায় তখন গুরুত্ব হারায়। এই কথাটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে মায়াবতীর ক্ষেত্রে। একজন দৃঢ়, ক্ষমতাশালী দলিত নেত্রী মায়াবতীর ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরের দিনগুলি খুবই কঠিন ছিল, যিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চাইতেন না। মায়াবতী নিজের এবং তাঁর দলের পতন স্বচক্ষে উপলব্ধি করেছেন। মায়াবতী দেখেছেন অনেক শীর্ষ নেতার দল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠা-সদস্যরা। নির্বাচনের আগে আগে তাঁর অনুগত প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাম আচার রাজভর ও লালজি বর্মা সপাতে যোগ দেন। শুধু তাই নয়, মায়াবতী ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের সর্বদাই কেন্দ্রীয় এজেন্সিদের মুখোমুখি হতে হয়।
উত্তরপ্রদেশে শেষ বহেনজি ম্যাজিক
কিন্তু এই নির্বাচনে মায়াবতী একেবারেই গোটা উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির চিত্র থেকে বাইরে চলে গেলেন। অস্তমিত বহেনজির ম্যাজিক। একটা সময় ছিল যখন দলিত ভোট মানেই বসপা ও মায়াবতী। দলিতদের মায়াবতীর অস্তিত্ব এখন সঙ্কটে। এবারের ইউপি নির্বাচনেও তেমন একটা প্রচারে দেখা যায়নি তাঁকে। বড় কোনও মুখও নেই তিনি ছাড়া। দলের নির্বাচনের ভার সতীশ চন্দ্র মিশ্রের কাঁধে দিয়েছিলেন মায়াবতী। কিন্তু তিনিও গণনার আগের দিন বসপা ছেড়ে দেন। এরপরই মায়াবতী তাঁর ভাই আনন্দ কুমারকে দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ভাইপো আকাশ আনন্দকে জাতীয় আহ্বায়ক হিসাবে ঘোষণা করেন। বৃহস্পতিবারের ফলাফল মায়াবতী ও বসপার ভবিষ্যতের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও চওড়া করে দিল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
মাত্র এক আসনে জয়, কেন উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে এতটা ব্রাত্য হলেন মায়াবতী