২৫ বছর ধরে চলছে লড়াই, কানপুরের বাঙালি বীরঙ্গনার কাহিনি অনুপ্রেরণা জোগাবে
পেরিয়ে গিয়েছে আড়াই দশক। কিন্তু, ৭১ বয়সে পৌঁছেও লড়াই ছাড়েননি চিন্ময়ী মৈত্র। কানপুরের এই বাঙালি বীরঙ্গনার কাহিনি সাহস জোগাবে প্রতিটি মানুষকে, বিশেষ করে যারা অন্য়ায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাঁদের।
পেরিয়ে গিয়েছে আড়াই দশক। কিন্তু, ৭১ বয়সে পৌঁছেও লড়াই ছাড়েননি চিন্ময়ী মৈত্র। কানপুরের এই বাঙালি বীরঙ্গনার কাহিনি সাহস জোগাবে প্রতিটি মানুষকে, বিশেষ করে যারা অন্য়ায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তাঁদের। কলকাতার উপকন্ঠে উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরে রয়েছে চিন্ময়ীর আদি ঠিকানা। মাঝে মধ্যে শ্যামনগরে আসা হয় বটে চিন্ময়ী-র। কিন্তু, কানপুর- সে তো শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে গিয়েছে। তাই সেখানকার সাকেত নগরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে কেটে যায় বছরের অধিকাংশ সময়টা। ৭১-এ শরীরটা আজ অসমর্থ কিন্তু এখনও আশা ছাড়েননি।
আদালতের নির্দেশে বারবার হার হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা বিএসএনএল-এর। তবু, নিজের প্রাপ্যের জন্য আজও লড়াই করে যেতে হচ্ছে চিন্ময়ী-কে। ১৯৯৪ সাল থেকে এক ছটাকও মাইনে পাননি বিএসএনএল-এর কর্মী চিন্ময়ী। কারণ তাঁর সঙ্গে হওয়া এক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। সেই প্রতিবাদের লড়াইটা এতটাই তীব্র ছিল যে চিন্ময়ীকে তাঁর অপমানের বিচার চাইতে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে হয়েছিল। আদালতের রায়ে বিজয়ীনি চিন্ময়ীকে বিনিময়ে পড়তে হয়েছিল বিএসএনএল-র রোষে। পরিণাম, মাইনে বন্ধ, চাকরি থেকে অন্য়ায়ভাবে বিতাড়িত।
সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন চিন্ময়ী। স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। সংসারে চিন্ময়ী এবং স্বামী তপন ছাড়াও তাঁদের আরও চার সন্তান। ২০১০ সালে স্বামী যখন গুরুতর অসুস্থ চিন্ময়ীর হাতে তখন মাত্র ২০৭ টাকা পড়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও স্বামীর চিকিৎসাই করাতে পারেননি। চোখের সামনেই বিনা চিকিৎসায় স্বামীকে মরে যেতে দেখেন। কোনও মতে দিন আনি দিন খাই পরিস্থিতিতে পড়ে থাকা চিন্ময়ী ও তাঁর সন্তানরা তবু লড়াই ছাড়েননি। ন্য়ায় বিচারের আশায় সমানে আদালতের কড়া নাড়িয়ে গিয়েছেন চিন্ময়ী।
১৯৯৮ সালে চিন্ময়ীকে কম্পালসারি রিয়ার্টমেন্টের নোটিস ধরিয়ে দিয়েছিল বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ। নিজের প্রাপ্যের জন্য লড়াইয়ের পরিণতি যে এতটা ভয়ঙ্কর হবে তা কল্পনাতেও আনতে পারেননি কানপুরের এই বাঙালি গৃহবধূ। বছরের পর বছর তাঁকে দিয়ে গ্রেড টু-এর কাজ করিয়ে নেওয়া হলেও গ্রেড থ্রি-র মাইনে ধরাচ্ছিল বিএসএনএল। এমনকী প্রোমোশনের সময় তাঁর থেকে ১২ বছরের জুনিয়ারকে গ্রেড থ্রি থেকে গ্রেড টু করে দেওয়া হলেও চিন্ময়ীকে তাঁর প্রাপ্য প্রোমোশন দেয়নি বিএসএনএল। বহু আবেদন-নিবেদনেও প্রাপ্য সম্মান না মেলায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। আদালতের রায় যখন বিএসএনএল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছিলেন তখন থেকেই এক ভয়ঙ্কর নারী বিদ্বেষের শিকার হতে থাকেন চিন্ময়ী।
বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ যে চিন্ময়ীর সঙ্গে অযথা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তা আদালতের প্রতিটি রায়েই স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু, জোর যার মুলুক তার। আদালতের নির্দেশের পরও চিন্ময়ীকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেয়নি বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ। কিছুদিন আগেও বিএসএনএল-এর রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। কিন্তু, তারপরেও নিরুত্তর এই টেলিকম সংস্থা।
কার্যত শয্যাশায়ী চিন্ময়ী এই শারীরিক অবস্থাতেই ভিডিও-তে ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলিকে বার্তা দিয়েছেন। জানিয়েছেন কীভাবে তাঁর সঙ্গে অন্যায় করেছে বিএসএনএল।
কানপুরে সরকারি কোয়ার্টারে থাকার দরুন বিএসএনএল ইতিমধ্যে ৩৪ লক্ষ টাকার বকেয়া ভাড়ার বিল ধরিয়েছে চিন্ময়ীকে। কিন্তু, যারা তাঁর প্রাপ্য মেটাচ্ছে না তারা এমন বিল কী করে পাঠায়? সে প্রশ্নও তুলেছেন চিন্ময়ী।
বিএসএনএল-এর মতো সংস্থায় অত্যন্ত উঁচু পদেই কাজ করতেন চিন্ময়ী। কিন্তু,কেন্দ্রীয় সরকারের এই দফতরের কিছু কর্মকর্তার 'ইগো'- শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। অর্থের অভাবে স্বামীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে বড় ছেলে এবং দুই মেয়েকে। নিচু ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের পড়িয়ে সংসারটাকে কোনওমতে টিকিয়ে রেখেছিলেন সন্তানরা। চিন্ময়ী-র বড় ছেলে ও দুই মেয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ছোট-ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছেন। আজ চিন্ময়ীর ছোট ছেলে মলয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর হাতে এখন সংসারের দায়িত্ব। আর দাদা-দিদিরা তাঁদের মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া পড়াশোনা-কে সম্পূর্ণ করতে এখন ফের পড়াশোনা শুরু করেছেন। এহেন পরিস্থিতিতে এখনও লড়াই ছাড়েননি চিন্ময়ী। সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আমরণ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পণ করেছেন।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলির পক্ষ থেকে চিন্ময়ী-কে নিয়ে এটাই শেষ প্রতিবেদন নয়, এমন আরও কিছু প্রতিবেদন আমরা প্রকাশ করব। যেখানে উঠে আসবে কী ভাবে পুরুষতান্ত্রিক কর্মক্ষেত্রে আপোষহীন এক মহিলাকে সবরকমভাবে শেষ করে ফেলার ষড়যন্ত্র কষা হয়েছিল। এই ধরনের ষড়যন্ত্র আমাদের সামাজের বুকে এতটাই চেপে বসেছে যে আদালতের রায়েও তার উৎখাত সম্ভব হয়নি।