১৩ থেকে ১৩: নরেন্দ্র মোদী এসেছেন বহু ক্রোশ
তিন মাস পর অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীর ইতিবাচক নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বিজেপি।
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর গত তিন মাসে বিজেপি যে পাঁচটি ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছেছে, তা হল:
নেতৃত্বের সঙ্কট মিটেছে
২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে লালকৃষ্ণ আদবানির যুগ। প্রসঙ্গত, আদবানি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতা চেষ্টা করেছিলেন নরেন্দ্র মোদীর উত্থানকে ঠেকাতে। কিন্তু, পারেননি। আসলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বিজেপি হইচই বাধাতে পারেনি দীর্ঘ একটা সময়। এই হতাশা দলকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। তবুও দলে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব নিয়ে মতৈক্য গড়ে উঠতে পারছিল না। কারণ, একাংশ মনে করতেন যে, পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের পথ প্রশস্ত হলে তা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ। কিন্তু, এই ধারণা এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানির পর দল দুর্বল নেতৃত্বের কারণে জেরবার হয়ে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদীর ইতিবাচক নেতৃত্ব সেই সঙ্কট থেকে বিজেপি-কে বের করে এনেছে।
সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি
উগ্র আদর্শবাদী নয়, বিজেপি এখন নিজেকে নমনীয় আদর্শবাদী হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এই বদল যিনি ঘটিয়েছেন, তিনি নরেন্দ্র মোদী ছাড়া আর কেউ নন। একটা মহল মনে করত, নরেন্দ্র মোদীর উত্থান ভারতের পক্ষে দুভার্গ্যজনক হবে। মনে করা হত, তিনি একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদী। কিন্তু, সেই সব মানুষকে ভুল প্রমাণ করে ছেড়েছেন নরেন্দ্র মোদী। অযোধ্যা আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের ডাক তিনি দেননি। বলেছেন, মন্দিরের থেকে শৌচালয়ের গুরুত্ব বেশি।
নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-র এই বদল উদারমনস্ক হিন্দুদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এটা থেকে প্রমাণ হয়, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছেন। অথচ লালকৃষ্ণ আদবানি প্রধানমন্ত্রী পদে বসুন, এই প্রার্থনা ছাড়া ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র আর কোনও পরিকল্পনা ছিল না।
নরেন্দ্র মোদীর বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি: বিদ্রোহীদের ফিরিয়ে নেওয়া, নতুন শরিক পাওয়া এবং সামাজিক জোট
বিজেপি-র বিদ্রোহীদের ফিরে পেতে বিশেষ জোর দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি পোড়খাওয়া নেতা। বড় নির্বাচনগুলিতে দলের ভালো-মন্দ স্থানীয় নেতাদের ওপর কতটা নির্ভরশীল, তা তিনি জানেন। ইতিমধ্যে কর্নাটকে বিজেপি-র প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে দলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত বাধায় দল ছেড়েছিলেন ইয়েদুরাপ্পা। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডিকেও দলে ফেরানো হতে পারে।
পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর থেকে তিনি চেষ্টা করছেন নতুন শরিকদের হাত ধরতে। আগস্টে হায়দরাবাদের জনসভায় তেলুগু দেশম পার্টিকে সঙ্গে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে একটি জনসভায় সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানালেও প্রশংসা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দিল্লিতে আমআদমি পার্টির নাম করে কিছু বলেননি। নরেন্দ্র মোদীর একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। তা হল, কংগ্রেস-বিরোধী শক্তিগুলিকে একটা ছাতার তলায় আনা। আবার, জনগণের মন পেতে পাকা হিসাব কষেছেন। যুবক, প্রাক্তন ফৌজি, স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে টানছেন। সমাজের এই অংশগুলি ইউপিএ-র কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ, তা তিনি জানেন।
ব্যাপক প্রচার
নরেন্দ্র মোদী জানতেন, পাঁচ রাজ্যের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচন তাঁর কাছে অগ্নিপরীক্ষা। যদি দল ব্যর্থ হত, গোটা দায় এসে পড়তে তাঁর ঘাড়ে। নিন্দুকরা দয়াদাক্ষিণ্য দেখাত না। তাই অন্তত চারটি রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি ও ছত্তিশগড়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য রাজ্যেও প্রচার চালিয়েছে। এর জেরে কতটা ভালো ফল পেয়েছে বিজেপি, বিধানসভা ভোটের পরিণাম দেখেই বোঝা গিয়েছে।
২০১৩ সালের পাঁচ বিধানসভা নির্বাচন
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি জিতেছে, কারণ স্থানীয় নেতারা সেই পথ সুগম করেছেন। কিন্তু, এই রাজ্যগুলিতে ভোটে দলের সাফল্যে নরেন্দ্র মোদীর কোনও ভূমিকা নেই, এমনটা ঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে দলের দুর্গরক্ষা হোক বা বিপক্ষের দুর্গে ফাটল ধরানো, নরেন্দ্র মোদী সব ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাদের সহায়তা করেছেন।
ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হানায় বিধ্বস্ত কংগ্রেস সহানুভূতি পেয়েছিল বিস্তর। এর জেরে রমন সিং হয়তো হেরেই বসতেন। কিন্তু, ঠিক সময়ে নরেন্দ্র মোদী আসরে নেমে পড়ায় তিনি রক্ষা পেলেন। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী কিন্তু, রাজস্থান ও দিল্লিতে অনুরূপ জাদু দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দিল্লিতে বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেতে পেতেও পেল না। কিন্তু, পরিস্থিতি বিচার করলে দেখা যাবে, কয়েক মাস আগেও দিল্লি বিজেপি-র যা দৈন্যদশা ছিল, কেউ আশা করেনি তারা বিধানসভা নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হবে। এখানেও নরেন্দ্র মোদীর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে তাঁর কথাতেই বদলানো হয়েছিল।
যদি কয়েক মাস পর লোকসভা ভোটের পাশাপাশি দিল্লিতে বিধানসভা ভোট হয়, তা হলে আমআদমি পার্টির চেয়ে বিজেপি সম্ভবত ভালো ফল করবে। 'নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসের বিকল্প'-- এই মন্ত্র তখন নির্ধারক হয়ে উঠবে।