কারফিউ থেকে ফ্লাডলাইটে - মোহনবাগানের পরের প্রতিপক্ষ রিয়াল কাশ্মীরের অবিশ্বাস্য উত্থানের কাহিনি
মোহনবাগানের পরবর্তী আই-লিগ প্রতিপক্ষ রিয়াল কাশ্মীর এফসির অবিশ্বাস্য উত্থান সম্পর্কে জেনে নিন।
শোনা যায় ভারতে এসে আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতি সেলিকাসকে বলেছিলেন, 'সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ'। সত্যি সত্যি ভারতে বৈচিত্রের কোনও অভাব নেই। শ্রীনগরের উপত্যকা থেকে কন্যাকুমারী উপকূল পর্যন্ত, ভৌগলিক বৈচিত্রে উজ্জ্বল ভারতবর্ষ। আর সেই ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় মানুষের জীবনধারা, খাদ্য, সংস্কৃতি। এই বৈচিত্রের মধ্যে ভারত-ঐক্যই তো আমাদের দেশের গর্ব।
আর এই মরসুমের আই লিগ এই ঐক্য স্থাপনে বড় ভূমিকা নিচ্ছ। মোহনবাগানের পরের প্রতিপক্ষ রিয়াল কাশ্মীর। ফুটবল দিয়েই কলকাতাকে ছুঁয়ে ফেলল শ্রীনগর। এবারের আইলিগের প্রথম ডিভিশনে কাশ্মীরের এই দলটিকে নিয়ে কিন্তু বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছে। ভীস্বর্গের মাঠে গঙ্গা পাড়ের ক্লাব নামার আগে মাইখেল বেঙ্গলি এখআনে উপস্থাপন করল আইলিগে কাশ্মীর থেকে খেলা প্রথম ক্লাবটির চমকপ্রদ উত্থানের কাহিনি।
ভারতের আইসল্যান্ড
কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জীবন সংগ্রামটা বোধহয় শুরু হয়ে যায় সেই শিশু বয়স থেকেই। কখনও গোলা-বারুদের গন্ধে ঢাকা পরিবেশে তাদের স্কুলে যেতে হয়। কখনও তাদের স্কুল বাসেও হয় পাথর হামলা। যদি সেসব নাও থাকে তাহলেও কাউকে কাউকে কয়েক ঘন্টার গাছপালা ঘেরা উপত্যকার মধ্য দিয়ে হেঁটে পৌঁছতে হয় স্কুলে। কখনও বা আচমকা নেমে আসে হরপা বান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা - জীবনের এই প্রতিনিয়ত নানাবিধ বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে করতেই বোধহয় তাদের মধ্যে যাবতীয় বাধাকে অতিক্রম করে যাওয়ার মনন সৃষ্টি হয়। ইউরোপে আমরা দেখেছি আইসল্যান্ডের উত্থান। রিয়াল কাশ্মীরের মধ্যে সম্ভাবনা আছে ভারতের আইসল্যান্ড হয়ে ওঠার।
দুর্যোগে শুরু যাত্রা
এই ক্লাবের উত্তেজক ফুটবল যাত্রাটিও কিন্তু শুরু হয়েছিল এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে। ২০১৪ সালে ভয়াল বন্যায় কাশ্মীরে বহু পরিবার ক্ষতির মুখে পড়েছিল। হাজার হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। মৃত্যুও হয়েছিল কয়েকশ' মানুষের। এই অবস্থায় তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী সন্দীপ চাত্তু এবং স্থানীয় সংবাদপত্র 'কাশ্মীর মনিটর'-এর সম্পাদক শামীম মেরাজ। এটাই ছিল রিয়াল কাশ্মীরের জন্মের প্রথম ধাপ।
ফুটবলেই মুখে হাসি
চাত্তু এবং মেরাজ নানাভাবে চেষ্টা করেও দেখেছিলেন কোনও ভাবেই শিশু-কিশোরদের মন থেকে সেই বিপর্যয়ের দাগ মুছে ফেলা যাচ্ছে না। জীবনের উদ্দেশ্যই হারিয়ে ফেলেছিল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছেলেরা। এই ধরণের ছেলেদেরই মাথায় জঙ্গিবাদ ঢোকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। শেষ পর্যন্ত চাত্তু এবং মেরাজ ফুটবলের দ্বারস্থ হন। বেশ কিছু ফুটবল কিনে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছেলেদজের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। এরপরই তাঁরা লক্ষ্য করেন ওইসব অঞ্চলে ফুটবল দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফুটবলের এই ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা বড় কিছু করার আশা দেখেছিলেন।
ফিরে দেখতে হয়নি
এরপর আর রিয়াল কাশ্মীর এফসি-র মালিকদের পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি। নিজেদের অ্যাকাডেমি গড়ে তোলেন। বছর দুয়েক আগে কোনও স্পনসর ছাড়াই আই লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনের প্রিলিমিনারিতে দল নামিয়েছিলেন। প্রথম বছরে নক আউট হয়ে যান। কিন্তু উপত্যকার বিশৃঙ্খলার মধ্যে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের নক আউট করে দেওয়াটা তো অত সহজ নয়। তারা নক আউট পাঞ্চ খেয়েও উঠে আসে। কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ়তার পুরস্কার পেয়েছিল এক বছর পরেই। আই লিগের দ্বিতীয় বিভিশনে একেবারে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা শেষ করে। জিতে গেলেই তাদের পুরস্কৃত করা হয়।
ভারতীয় ফুটবলের মূল মঞ্চে
এর ফলে, কাশ্মীর থেকে আই-লিগে খেলা প্রথম দল হিসাবে এই মরসুমে রিয়াল কাশ্মীর এফসি খেলছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এই মরসুমে এখন পর্যন্ত তারা ৩ ম্যাচ খেলে ১টি হেরেছে, ১টি ড্র করেছে, আর হারিয়েছে আই লিগের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের। যে রাজনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিদিন কাটাতে হয় তার নিরিখে এই ফলকে বিচার করলে বোঝা যায় তা কতটা অবিশ্বাস্য।
রিয়াল সুপারস্টার
উত্থানের পথে বিভিন্ন বাধা টপকে আজ কাশ্মীর উপত্যকায় ফুটবলকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে রিয়াল কাশঅমীর। তাদের প্রতিটি খেলায় গোলা-বারুদ, পাথর ছোঁড়া ভুলে হাদার হাদার দর্শক জড়ো হচ্ছেন মাঠে। সারা দেশে ফুটবল ভক্তরা লিও মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, নেইমার জুনিয়র-দের মতো সুপারস্টারদের একবার দেখা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের সত্যিকারের সুপারস্টাররা কিন্তু নীরবেই তাদের কাজ করে চলেছেন।
এই চুড়ান্ত প্রতিযোগিতার পরিবেশে, পেশাদারিত্বে মোড়া সময়ে ফুটবল যে ঐক্যবন্ধনের ভূমিকা নিচ্ছে তাই এই খেলাকে এত সুন্দর করে তুলেছে।