
ডার্বির আবহে ফুটছে ময়দান, বাঙালি ফুটবলারের অভাবে ঐতিহ্যের ম্যাচে চেনা আবেগে ভাটা পড়েছে মত মেহতাব-স্নেহাশিসদের
রাত পোহালেই মহারণ। এশিয়া ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বৈরথে শনিবাসরীয় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে মুখোমুখি হতে চলেছে ভারতীয় ফুটবলের দুই সেরা দল ইস্টবেঙ্গল এবং এটিকে মোহনবাগান। ঐতিহ্যের লড়াই বিগত এক শতাব্দী ধরে কত ইতিহাসের সাক্ষী থেকে কত রূপকথা তৈরি হয়েছে সবুজ মাঠে, তার হিসেব হয়তো নেই পরিসংখ্যানবীদদের কাছেও। এটাতো শুধু একটা ম্যাচ নয়, এটা আবেগ, পরম্পরা, ঐতিহ্য, কৌলিন্যের লড়াই। বিগত একশো বছরে এই ম্যাচ যেমন সদর্পে মাথা ঊঁচিয়ে রাজ করেছে, তেমনই আগামী দিনের এশিয়া তথা বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা ডার্বি রাজ করবে তা মেনে নিতে কোনও দ্বিধা রাখার অবকাশ নেই। শতবর্ষ পেরিয়ে ডার্বিতে করপোরেটের ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, কিন্তু মাটির গন্ধ, রেষারেষিটা রয়ে গিয়েছে আদি অকৃত্তিম। শনিবাসরীয় মহারণে বাঙালির বিভাজনের দিন বহু ডার্বি ম্যাচের নায়ক প্রাক্তনীরা নিজেদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।

মেহতাব হোসেন:
ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান উভয় দলেই দীর্ঘ দিন খেলেছেন ভারতীয় ফুটবলে সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার মেহতাব হোসেন। শনিবারের মহারণের আগে মেহতাব বলছিলেন, "ডার্বি সব সময়েই ৫০-৫০ ম্যাচ, এখানে কোনও ভবিষ্যৎবাণী চলে না, খাটেও না। তবে, ইস্টবেঙ্গল কোচকে এই ম্যাচের আগে ফুটবলারদের বোঝাতে হবে যে ২০১৯ সাল থেকে লাল-হলুদ ঐতিহ্যের লড়াইয়ে জিততে পারেনি। কোনও রকম অজুহাত দেওয়ার জায়গা নেই, এখন রেজাল্ট দেওয়ার সময়। কোচ নিজে বিদেশি বাছাই করে এনেছেন, এটা কোনও ছোট ক্লাব নয়, পারফর্ম না করতে পারলে কোচকে জবাব দিতে হবে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে অজুহাত চলে না। অগস্ট থেকে এই দলটাকে তৈরি করার সময় পেয়েছে কোচ, ভারতীয় ফুটবল কালচারটা জানেন তিনি।" মেহতাব জানিয়েছে, যে এই ম্যাচে চাপ সামলে নিজেদের সেরাটা দেবে সেই জিতবে। তাঁর কথায়, "দিনটা কার যাবে তার উপর নির্ভর করছে। ৯৯ শতাংশ পরিশ্রম লাগলেও ১ শতাংশ ভাগ্য প্রয়োজন এই ম্যাচ জেতার জন্য। যার ভাগ্য সঙ্গে থাকবে সেই দল জিতবে।" স্টিফেন এবং ফেরান্দোর স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে মেহতাব বলেছেন, "এক জন কোচ আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলান, অপর জন ডিফেন্স সামলে খেলেন। ইস্টবেঙ্গল। লাল-হলুদের ডিফেন্সের সঙ্গে সবুজ-মেরুনের আক্রমণের একটা দ্বৈরথ হতে চলেছে।"

সংগ্রাম মুখোপাধ্যায়:
ইস্টবেঙ্গলের রিজার্ভ দলের গোলরক্ষক কোচ সংগ্রাম মুখোপাধ্যায় আশাবাদী ডার্বির আগে ইস্টবেঙ্গলকে নিয়ে। তিনি বলেছেন, "শেষ ম্যাচটা খুব ভাল খেলেছে। প্রতি ম্যাচে উন্নতি করছে। তিনটে ম্যাচ দেখেছি, শেষ ম্যাচটায় ভাল ভাবে ফিরে এসেছে। ডার্বির আগের ম্যাচে জিতলে মানসিক ভাবে দল অনেকটাই চাঙ্গা থাকে। দুই-একজনের পরিবর্তন হয়েছে, তা ছাড়া মোহনবাগান এক টিমই ধরে রেখেছে। বেশ ভাল দল এবং দলগত ফুটবলের উপর জোর দিচ্ছে। ডার্বি সব সময় ৫০-৫০, কেউ এগিয়ে নেই, যে এই ম্যাচে সঠিক ভাবে মনোযোগ দিতে পারবে সেই জিতবে।"

দীপঙ্কর রায়:
ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে হিসেবে পরিচিত দীপঙ্কর রায়। দীর্ঘ সময়ে লাল-হলুদের মাঝমাঠে দাপানোর পাশাপাশি তিনি খেলেছেন জেসিটি, মহমেডান স্পোর্টিং-এর মতো ক্লাবে। এ ছাড়া ভারতের জার্সিতেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ডার্বিতে কোনও দলকে এগিয়ে না রাখলেও একটা প্রতিদ্বন্দ্বীতা মূলক ম্যাচ যে হতে চলেছে তা মুক্ত কন্ঠে জানিয়েছেন দীপঙ্কর। তিনি বলেছেন, "শেষ ম্যাচ জেতার ফলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ডার্বিতে নামবে ইস্টবেঙ্গল। বড় ম্যাচ সব সময়ে সম্মানের লড়াই, ম্যাচটা ৫০-৫০ থাকে কিন্তু যে দল অতিরিক্ত দশ শতাংশ দেবে সেই দল জিতবে। আমি অধিকাংশ বড় ম্যাচে দেখেছি যে দল একটু পিছিয়ে থাকে তারাই আগাগোড়া ভাল খেলে। আশা করছি ইস্টবেঙ্গ এই ম্যাচটা ভাল খেলবে এবং ভাল রেজাল্ট পাবে।" ফুটবলারদের তুল্যমূল্য বিচারে দীপঙ্কর এগিয়ে রেখেছেন এটিকে মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের। তিনি বলেছেন, "বিষয় হল ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলারদের থেকে মোহনবাগানের ফুটবলাররা অনেক ভাল, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মোহনবাগান একটা কমপ্যাক্ট দল, ইস্টবেঙ্গল সেই তুলনায় একটু হলেও পিছিয়ে। তবুও বড় ম্যাচটাতো বলা যায় না কারণ বড় ম্যাচ সম্মানের লড়াই। ইস্টবেঙ্গল বিভিন্ন কারণে বিগত দুই বছর ধরে দল করতে পারছে না ঠিক মতো, সেই জন্য হয়তো কাঙ্খিত ফলাফল পাচ্ছে না। আমাদের সময়ে আই লিগ শেষ হওয়ার মাস দুয়েক আগে থেকেই দল তৈরির কাজ শুরু করে দিত। এখন দশ দিনে দল করতে হচ্ছে, একটা ডামাডোল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, আশা করব পরের বছর থেকে তেমনটা হবে না। আশা করছি পরের বছর থেকে ইস্টবেঙ্গলের এই সমস্যা হবে না, একটা ভাল জায়গায় থাকবে। মোহনবাগান ভাল দল, দলটা এক সঙ্গে খেলছে অনেক দিন, নতুন স্ট্রাইকার গোল পাওয়া অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল শেষ ম্যাচটা জেতায় সমর্থকেরা লাল-হলুদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আশা করা যায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।"

স্নেহাশিস চক্রবর্তী:
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে ফুটবলারদের মধ্যে যেই আবেগটা থাকা প্রয়োজন তার অভাব রয়েছে মনে করছেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে স্নেহাশিস চক্রবর্তী। তিনি বলেছেন, "আগে আমরা যে সময়ে খেলেছি তখনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলায় একটা আবেগ ছিল। এখন সেই আবেগটা দর্শকদের মধ্যে রয়েছে কিন্তু ফুটবলারদের মধ্যে নেই। বাঙালি খেলোয়াড় এত কমে গিয়েছে দুই দলে যে আবেগ নেই, আর দায়িত্বও নেই। বাঙালি ফুটবলার কমে গেলে আবেগটাও কমে যায়। ম্যাচ অবশ্যই ৫০-৫০। তবে, তুল্যমূল্য বিচারে সব বিভাগে মোহনবাগান এগিয়ে। যে ভাল খেলবে সে জিতবে।" বাঙালি ফুটবলার না থাকায় খেলোয়াড়দের মধ্যে আবেগ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্নেনাশিস বলেছেন, "একটা বাঙালি ছেলে ছোট থেকে যে পাড়ায় মানুষ হচ্ছে সেখানে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক রয়েছে, মোহনবাগান সমর্থক রয়েছে। হারলে তাদের জবাব দিতে হয়, তার বাবা-মা'ও হয়তো কেউ ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, কেউ মোহনবাগান সমর্থক, তাঁদেরও একটা আবেগ রয়েছে, সব কিছু নিয়েই এই ম্যাচটাকে ঘিরে একটা আবেগ তৈরি হয়। ভিন রাজ্যের খেলোয়াড়রা কোনও দিন সেই আবেগটা অনুভব করতে পারবে না, হারলেও কোনও ব্যপার নয়, জিতলেও কোনও ব্যপার নয়, কর্পোরেটের মতো, ৯০ মিনিট শেষ ওখানেই সব কিছু শেষ। আবেগ না থাকলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা যায় না। এখন ছোট টিম বড় দলকে ডোমিনেট করবে। কলকাতা লিগের উপর যদি জোর দেয় আমার মনে হয় বাঙালি ছেলেরা উঠে আসবে।"

শুভাশিস রায় চৌধুরি (ডিফেন্ডার):
দীর্ঘ সময় ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানে দাপিয়ে খেলা ডিফেন্ডার শুভাশিস রায় চৌধুরি মনে করেন দুই দলের ফুটবলারদের মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টা কমে গিয়েছে। তিনি বলেছেন, "ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের যা খেলা দেখি এখন তাতে একটা বিষয় পরিস্কার কেউ বাড়তি তাগিদ নিচ্ছে না। স্কোয়ার পাস, ব্যাক পাস আর দুই গজের পাস। সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতাটা নেই, সবাই শুধু নিজের দায় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে আর মিস পাস যাতে না হয় শুধু সেটাই খেয়াল রাখছে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ একটা আবেগের ম্যাচ, সবাই এই ম্যাচটার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। আমরা আমাদের খেলোয়াড় জীবনে সারা বছর এই ম্যাচটার জন্য অপেক্ষা করতাম। ছেট দলে যখন খেলেছি তখন এদের বিরুদ্ধে ভাল খেলব তার জন্য অপেক্ষা করেছি, বড় দলে যখন গিয়েছি তখন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ কখন আসবে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবতাম। এই যে আবেগটা এবং তাগিদটা এখন অর্ধেক খেলোয়াড়ের মধ্যে নেই। বাঙালি ফুটবলার কমে যাওয়ার এর কারণ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের ওজনটা যদি না বুঝতে পারে তা হলে সেই খেলার বিষয়টাও থাকবে না। এখনকার বাঙালি খেলোয়াড় যারা সুযোগ পাচ্ছে তারা সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারছে না। খেলছি টাকা পেয়ে যাচ্ছি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জার্সি পড়ছি ব্যস ওইটুকুই। প্রথম দলে লাগাতার খেলতে হবে, ভাল খেলতে হবে এই তাগিদটা এখন খুব কম খেলোয়াড়ের মধ্যে আছে। যত দিন এই ম্যাচের আবেগটা এরা বুঝতে না পারবে এবং যত দিন এই ম্যাচের মূল্য বুঝতে না পারবে বা বাঙালি ছেলেরা যত দিন বেশি করে এই ম্যাচে না খেলছে তত দিন ভাল পারফর্ম করতে পারবে না। আশা করব দুই দলের খেলোয়াড়ারা ভাল পারফর্ম করবে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জার্সির যে ওয়েট সেই জার্সি পরে যে পারফরম্যান্স দেওয়া দরকার সেটা দর্শকদের জন্য দেবে। আমরা ফুটবল খেলেছি সমর্থকদের জন্য। দূর দূর থেকে মানুষ এই ম্যাচ দেখতে আসে। সেই আশা পূরণ করতে না পারলে খেলে লাভ নেই। খেলতে হয় খেলছি, বড় ম্যাচে ভাল খেলব, দলকে জেতাব এই আবেগটা যদি না খাকে তা হলে মুশকিল, আবেগটা রেখেই খেলতে হবে।"
খিদিরপুরের বিরুদ্ধে বড় জয়, কলকাতা লিগ জেতা কার্যত নিশ্চিত করে ফেলল মহমেডান স্পোর্টিং