রাম সেতু পরিচিত ‘আদম সেতু’ নামেও! জানেন কেন হল এই নাম, সেও এক অজানা কাহিনি
রাম সেতু পরিচিত ‘আদম সেতু’ নামেও! জানেন কেন হল এই নাম, সেও এক অজানা কাহিনি
কথিত আছে রাম সীতা উদ্ধারের সাগরের উপর নির্মাণ করেছিলেন ভাসমান শিলার সেতু। তারপর এই সেতু পেরিয়ে লঙ্কায় গিয়ে রাবণের শৃঙ্খল থেকে সীতাকে মুক্ত করেছিলেন। সেই থেকেই ওই সেতু রাম সেতু নামে পরিচিত হয়ে আসছে। কিন্তু জানেন কি এই সেতুর আরও একটি নাম আছে। তা হল আদম সেতু! কেন রাম সেতুর নাম হল আদম সেতু, তা কি জানেন? আসুন, জেনে নিই সেই অজানা কাহিনি!
রাম সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে হজরত আদমের কাহিনিও
রাম সেতু বা আদম সেতু নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। তামিলনাড়ুর পাম্বান আইল্যান্ডের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ধনুস্কোডি থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার আইল্যান্ডের তালাইমান্নার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সেতু। কিন্তু অনেকের মতো সরাসরি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যোগ ছিল এই সেতুর। এই সেতু ভগবান রাম কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে যেমন অনেক মানুষের বিশ্বাস রয়েছে, অনেক মানুষ মনে করেন এই সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হজরত আদমের কাহিনিও।
রাম সেতু পেরিয়ে শ্রীলঙ্কায় আদম পিক নামে পর্বত
রাম সেতু আদমের সেতু বলেও বিশেষ পরিচিত। এই আদমের সেতু নামটি এসেছে প্রাচীন ইসলামিক গ্রন্থ থেকে। শ্রীলঙ্কায় 'আদম পিক' নামে একটি পর্বত রয়েছে। সেখানে চূড়ার ঠিক কাছে রয়েছে 'শ্রীপদ' নামের একটি পবিত্র পায়ের ছাপ। ৭৩৫৯ ফুট উচ্চতায় সেই পায়ের ছাপের দৈর্ঘ্য ছিল ১.৮ মিটার বা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।
যে কারণে রাম সেতু পরিচিত আদমের সেতু নামেও
হাদিস বা কোরান আয়াতে উল্লেখ না থাকলেও কথিত আছে হজরত আদম যখন দুনিয়াতে এসেছিলেন, তখন শ্রীলঙ্কার ওই আদম পিকে পদার্পণ করেছিলেন। ওই পর্বতচূড়ায় তিনি এক হাজার বছর প্রার্থনা করেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে। সেই পায়ের ছাপই এটি, এমনটাই মনে করা হয়। তারপর পর্বত চূড়া থেকে নেমে তিনি ওই সেতু পেরিয়ে ভারতে আসেন। তখন থেকে ওই সেতুর নাম হয় আদম সেতু।
‘শ্রীপদ’ নামের পবিত্র পায়ের ছাপ নিয়ে ভিন্ন মত
মুসলিমরা ওই 'শ্রীপদ'কে আদমের পায়ের ছাপ বলে বর্ণনা করেন। আর হিন্দুরা মনে করেন ওটি শিবের পায়ের ছাপ। আবার বৌদ্ধগণ মনে করেন, তা গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপ। তবে শ্রীপদ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন দাবি থাকলেও সেখানে সেতু নিয়ে কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। হিন্দু ধর্মে মানা হয়, সীতৈ উদ্ধারের জন্য শ্রীরাম ওই সেতু বানিয়েছিলেন
রাম সেতু বা আদম সেতু আবার নল সেতুও, সেতুবন্ধনমও
রাম সেতু বা আদম সেতুকে আবার অনেকে নল সেতুও বলে থাকে। এই নাম এসেছে রামায়ণ থেকে। কারণ নল ওই সেতু তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা মতোই রাম সেতুটি নির্মাণ করেন বানর সেনার সহায়তায়। মাত্র ৫ দিনে ওই সেতু নির্মাণ হয়েছিল রামেশ্বরম থেকে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য। আবার রামায়ণে এই রাম সেতুকে সেতুবন্ধনম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইবনে খোরদাদবেহ ও আলবিরুণির লেখায় আদম সেতুর উল্লেখ
সপ্তদশ শতকে মুঘল আমলের একটি মানচিত্রও পাওয়া যায়, সেখানে ওই এলাকাকে রামমন্দির এলাকা বলে উল্লেখ রয়েছে। মার্কোপোলোর ভ্রমণ লেখনিতে সেতুবন্ধ রামেশ্বরম নামে ডাকা হয়েছে। আবার মার্কোপোলো আদম সেতুও উল্লেখ করেছেন। ইবনে খোরদাদবেহের লেখায় সেতবান্ধাই বা সমুদ্রের সেতু আর আলবিরুণির লেখায় আদম সেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭৪৭ সালে এক ডাচ মানচিত্র নির্মাতার একটি মানচিত্র পাওয়া যায় তাঞ্জাভুর সরস্বতী মহল লাইব্রেরিতে। সেখানে তিনি রামনকয়েল নামে অভিহিত করেছেন। যা এসেছেন তামিল শব্দ রামন কোভিল থেকে। যার অর্থ রামমন্দির।
রাম সেতুর উৎস নিয়ে আজও বিতর্ক, আশ্চর্যের তথ্য
সেতুর উৎপত্তি নিয়ে আজও বিতর্ক লেগে রয়েছে। কারও মতে সমুদ্রের বুকে চর জেগে এই সেতুর সৃষ্টি হয়েছিল। কারও মতে শ্রীলঙ্কা স্থলভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করা এই সেতুর সৃষ্টি হয়েছিল প্রাকৃতিকভাবেই। চারকোণা পাথরগুলো সময়ের সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে সজ্জিত রয়েছে। প্রজেক্ট রামেশ্বরম নামে একটি গবেষণা চালানো হয় সেতু নিয়ে। সেখানে উৎপত্তি নিয়ে কিছু তথ্য উঠে আসে, যা আশ্চর্যের।
রামেশ্বরম দ্বীপ ও রাম সেতুর গবেষণা ও কিছু তথ্য
ওই গবেষণায় জানা যায়, রামেশ্বরম দ্বীপ গঠিত হয় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে। কিন্তু কার্বন ডেটিং অনুযায়ী জানা যায়, রামেশ্বরম ও তালাইমান্নারের মাঝের অংশ সমুদ্র থেকে উঠতে শুরু করে সাত হাজার থেকে ১৮ হাজার বছর আগের কোনও এক সময়ে। ভারত সরকার ২০০৭ সালে জানায়, রাম কর্তৃক সেতু নির্মাণের কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ২০০৮ সালে এক মামলায় বলা হয়, রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের পর এই সেতু ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। সেই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।
৭৪০ বছর আগের ঘূর্ণিঝড়ে তলিয়ে যায় সেতুর একাংশ
সেতুটি এখন অনেক জায়গাতেই সমুদ্র-গর্ভে নেমে গিয়েছে। অগভীর জায়গাতে চুনাপাথরের গভীরতা আসলে ১ মিটার বা তার মধ্যে। তবে অন্য জায়গায় তা ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর। এই সেতু দিয়ে বর্তমানে চলাচল করা না গেলেও পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়ার অবস্থা ছিল। মানুষ যেতে পারত। মন্দিরের নথি অনুযায়ী ১৪৮০ সালে এক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল, যার ফলে এই সেতু ভেঙে যায়। তলিয়েও যায় অনেকাংশ।
ছবি সৌ:নাসা ও উইকিপিডিয়া