ভারতের এক ‘অখ্যাত’ গ্রামের গল্প, দারিদ্র্যের শাপমুক্তি ঘটিয়ে ৩০ বছরেই ৬০ ‘কোটিপতি’
ভারতের এক ‘অখ্যাত’ গ্রামের গল্প, দারিদ্র্যের শাপমুক্তি ঘটিয়ে ৩০ বছরেই ৬০ ‘কোটিপতি’
এ এক অখ্যাত গ্রামের গল্প। পশ্চিম ভারতের এ গ্রাম আজ থেকে ৫০ বছর আগে খরার কবলে পড়েছিল। দারিদ্র্য গ্রাস করেছিল গোটা গ্রামকে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে আচমকাই বদলে যায় গ্রামের ভাগ্য। দারিদ্র্যের শাপমুক্তি ঘটে। এক গ্রামে ৬০ জন কৃষক কোটিপতি বনে যান। কী করে সম্ভব হল এই অসাধ্য সাধন। সেই গল্পই তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
হিওয়ার বাজারের কোটিপতি হওয়ার গল্প
গ্রামের নামটি হিওয়ার বাজার। মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলায় অবস্থিত। আজ থেকে ৫০ বছর আগে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছিল এই গ্রাম। খরার সব হারিয়ে গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার ২০ বছরের মধ্যেই ঘটে গেল মিরাকেল। হতদরিদ্র গ্রাম হিওয়ার বাজার হয়ে উঠল কোটিপতিদের গ্রাম। এ গ্রামে এখন ৬০ জন কোটিপতি।
‘ব়্যাগ টু রিচ’ সাফল্যের কৃতিত্ব যাঁর
৬০ জন কোটিপতি সবাই-ই কৃষক। তাঁদের কল্যাণেই এই গ্রাম এখন ধনী গ্রামে পরিণত হয়েছে। এই ব়্যাগ টু রিচ সাফল্যের কৃতিত্ব পোপাতারাও বাগুজি পাওয়ারের। তিনি গ্রামের প্রধান হয়েই এই গ্রামের ভোল বদলে দিয়েছিলেন এক লহমায়। আর্থ-সমাজিক পরিকাঠামো চিরতরে বদলে গিয়েছিল। ৯৫-এর দশকে যেখানে প্রতিমাসে গড় ৮৩০ টাকা রোজগার ছিল মানুষের, তা এখন বেড়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা হয়েছে।
ভারতের বুকে এক আদর্শ ও বিরল গ্রাম
হিওয়ার বাজার গ্রামে মাত্র ১২৫০ জনের বাস। তার মধ্যে ৬০ জন কোটিপতি। এই গ্রামটি উন্নয়নশীল জাতির একটি চমৎকাল দৃষ্টান্ত হয়ে গিয়েছে। একটা সময় খরায় সব শেষ হয়ে গিয়েছিল এই গ্রামে। এখন সেখানে জমজমাট বাজার, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, সবুজ মাঠ, সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি এবং গাছ-গাছালি ঘেরা সুন্দর বাগান। সত্যিই ভারতের বুকে এক আদর্শ ও বিরল গ্রামে পরিণত হয়েছে এ গ্রাম।
৩০ বছর ধরে উত্তরণের পথে জুড়ি মেলা ভার
এমন সুন্দর সাজানো-গোছানো গ্রামের জুড়ি মেলা ভার। এই গ্রামে খেলা জায়গায় মল-মুত্রত্যাগ, তামাক-অ্যালকোহল সেবন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। যতদিন যাচ্ছে ততই গ্রামটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিগত ৩০ বছর ধরে উত্তরণের পথে এগিয়ে চলছে গ্রামটি। ভারতের অধিকাংশ বর্ধিষ্ণু গ্রামের তুলনায় এ গ্রামের উপার্জন দ্বিগুণ। আর সেই উপার্জন এসেছে সৎ উপায়ে। মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাত্রা এ গ্রামের নজরকাড়া।
অতৃপ্তের জ্বালায় বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিল যখন
এখন যে দৃশ্য দেখা যায় গ্রামে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে কিন্তু এই গ্রাম তেমনটা ছিল না। ১৯৭২ সালে যে খরার কবলে পড়েছিল গ্রাম। তার ছাপ ছিল পরতে পরতে। বছরের পর বছর খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে এই গ্রামের অবস্থা। কুয়োগুলি শুকিয়ে পরিত্যক্তের চেহারা নেয়। জলের অভাব প্রকট ছিল। আয়ের কোনও উৎস ছিল না। আর এই অতৃপ্তের জ্বালায় বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিল। অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি বাড়ছিল। বাড়ছিল গার্হস্থ্য হিংসা।
অন্ধকারে আলোর রেখা দেখা যায় যে পথে
এই পরিস্থিতিতে ৯০ শতাংশ মানুষই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শহরতলিতে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন আয়ের খোঁজে। হতাশাগ্রস্ত জীবনের অবসান ঘটাতে গ্রামের যুবকরা তখন তৎপর হন, এমন একজনের খোঁজে যিনি এই গ্রামের হালহকিকৎ আমূল বদলে দিতে পারেন। নতুন করে গ্রামকে গড়ে তুলতে পারেন। তখনই গ্রামের প্রধান বা সরপঞ্চ হিসেবে নিয়োগ করা হয় এক তরুণ-তুর্কিতে। তাঁর হাত ধরেই আলোর রেখা দেখতে পায় অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এই গ্রামের মানুষ।
কয়েক বছরের মধ্যে আমূল বদলে যায় চেহারা
সেটা ছিল ১৯৮৯ সাল। মহারাষ্ট্রের এই হিওয়ার বাজারের উত্তরণ শুরু হয়। পাঁচ বছরের মধ্যে আমূল বদলে যায় চেহারা। গ্রামের সমস্ত মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধূমপান, মদ্যপান ও তামাকসেবন একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। প্রথমে গ্রামে সুস্থ সমাজ ফিরিয়ে আনেন ওই সরপঞ্চ। তারপর তিনি গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মন দেন। কী করে অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর বদল ঘটানো যায়, সেই পরিকল্পনা শুরু করেন গ্রাম প্রধান।
বৃষ্টিছায়া এলাকায় থাকা গ্রামের বদলের নেপথ্যে
গ্রামটি একটি বৃষ্টিছায়া এলাকায় অবস্থিত। প্রতি বছরই এই গ্রামে স্বল্প বৃষ্টি হয়। মেরেকেট ১৫ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয় সারা বছরে। ফলে জলের চাহিদা মেটানো অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় তিনি ঋণ নিয়ে এই গ্রামে বৃষ্টির জল সংগ্রহ এবং জলাশয় সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রামবাসীকে নিয়ে রাজ্য সরকার তহবিল ব্যবহার করে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার জন্য ৫২টি মাটির বাঁধ, ৩২টি পাথরের বাঁধ, চেক ড্যাম ও পারলোকেশন ট্যাঙ্ক স্থাপন করেন। সেইসঙ্গে লাগানো হয় হাজার হাজার গাছ।
কৃষিকাজ আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে এ গ্রামে
এর ফলে গ্রামবাসীরা সেচের সুবিধা পান এবং বিভিন্ন ফসল ফলাতে সম্ভবপর হন। বর্তমানে এই গ্রামে ২৯৪টি জলের কূপ রয়েছে। গ্রামের চারপাশে কুয়ো তৈরি হয়। এর ফলে কৃষিকাজ আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে এ গ্রামে। এবং তা গ্রামবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে। এ গ্রামে শুরু হয় কম জল ব্যবহারী ফসল উৎপাদন। শাকসবজি, ডাল, ফল ইত্যাদি চাষ হয়। চাষ হয় ফুলও।
দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে মাত্র তিনটি পরিবার
শুধু চাষাবাদই নয়, পশুপালনেও মনোনিবেশ করা শুরু করেন ওই গ্রাম প্রধান। গবাদি পশু পালনে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বিপুল রাজস্ব আদায় শুরু হয়। এখন এই গ্রামে ৩৩ গ্যালন থেকে বেড়ে ৮৮০ গ্যালন দুধ উৎপাদন হয়। প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট গ্রামটি সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। ১৯৯৫ সালে এই গ্রামে ১৮২টি পরিবারের মধ্যে ১৬৮টি দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিল, এখন দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে মাত্র তিনটি পরিবার।
হিওয়ার বাজার গ্রাম ও তার আদর্শ পরিষেবা
এই হিওয়ার বাজার গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে টয়লেট রয়েছে। প্রতিটি পরিবার বায়োগ্যাস ব্যবহার করে। এ গ্রামে স্কুল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও যথাযথ। গ্রামে রয়েছে বিদ্যুতের সুবন্দোবস্ত। এ গ্রামে কোনও পরিবারের দ্বিতীয় কন্যার শিক্ষা ও বিবাহের খরচ গ্রামের তরফে বহন করা হয়। ৬০ শতাংশেরও বেশি পড়ুয়া মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করছে। এই গ্রাম পরিবার পরিকল্পনা মেনে চলে। স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতামূলক সমস্ত ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা মান্যতাও দেওয়া হয়।
অনুরূপ ১০০টি গ্রাম তৈরি করা হচ্ছে
ইতিমধ্যেই দেশের বুকে আদর্শ গ্রামের তকমা ছিনিয়ে নিয়েছে মহারাষ্ট্রে হিওয়ার বাজার। মহারাষ্ট্র সরকার এই স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৬ সালে মন কি বাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গ্রামের প্রধান ও গ্রামবাসীদের এই অসমান্য উদ্যোগকে প্রশংসিত করেছেন। এরপর পোপাতারাও পাওয়ারকে মহারাষ্ট্রের মডেল ভিলেজ প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। অনুরূপ ১০০টি গ্রাম তৈরি করা হচ্ছে। যদি এইভাবে এগনো যায়, তবে গ্রামে কেউ দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকবে না।
দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ৬০ কোটিপতির গ্রাম
১৯৯৫ সালে গ্রামের মাত্র ১০ শতাংশ আবাদযোগ্য ছিল। ২০১০ সাল নাগাদ এই গ্রামের গত আয় বিশ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামের ৫০ জন কোটিপতি হয়েছিলেন। মাত্র তিনটি পরিবার দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিল। ২০০০ সালের পর মাত্র চার বছরে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ১০০ টন থেকে ৬ হাজার টন হয়। অর্থাৎ ৬০ গুণ বৃদ্ধি পায় উৎপাদন। আর দুধের উৎপাদন ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে পর্যন্ত ২০ বছরে বৃদ্ধি পায় ২৫ গুণ। এভাবেই এই গ্রামে এখন ৬০ জন কোটিপতি রয়েছেন। গ্রামের অধিকাংশই আজ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধনী ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছেন।