স্বপ্নের ডালে ভেসে চার চিনার দ্বীপ, ভূস্বর্গে যেন রহস্য অপার
রাজধানী দিল্লি থেকে স্পাইসজেট এস জি ১৩০ উড়ানটা যখন শ্রীনগরের রানওয়ে ছুঁলো তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা ৪৫।
রাজধানী দিল্লি থেকে স্পাইসজেট এস জি ১৩০ উড়ানটা যখন শ্রীনগরের রানওয়ে ছুঁলো তখন ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা ৪৫। প্লেন টু কনভেয়ার-বেল্ট টু এয়ারপোর্টের বাইরে পাক্কা কুড়ি মিনিট। হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন কেনারামদা।
কেনারাম বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি হুগলির দিয়ারায়। আগামী কয়েক দিনের জন্য তিনিই আমাদের ভ্রমণ গাইড কাম লোকাল গার্জেন কাম সবকিছু। জেকে ২১/৫৬২৭ উইংগারের চালক প্রীতম সিং একাই আমাদের সব মালপত্র গাড়ির ছাদে তুলে বিনয়ের সঙ্গে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। সেখান থেকে সরাসরি ঝিলম নদীর ধারের হোটেল আল হামজা। মূল রাস্তা থেকে ঢালের মুখে এ যেন এক ছোটখাটো সুদৃশ্য প্রাসাদ। শুনলাম, সেখান থেকে কিছুদূর এগোলেই নাকি ডাল লেক।
হোটেলে উপলব্ধি
মনটা খুঁত খুঁত করছিল এই ভেবে যে ডাল লেকের ধারে হোটেল পেলাম না। পরক্ষণেই উপলব্ধি করলাম, এও বা কম কীসে! ঘরের জানলার পর্দা সরালেই নজরে পড়ে লেকের কালচে আবরণ পেরিয়ে পাহাড়ের মাথায় একটা মন্দিরের চূড়া। রুম সার্ভিস বয় জানাল, ওটা সেই বিখ্যাত শঙ্করাচার্যের মন্দির।
আরও দূরে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণী কোথা থেকে কোথায় গিয়ে যে মিশেছে, তা চোখে পড়ে না। অনেক ছোটবেলায় ভূগোলে পড়া স্বপ্নের ডাল বেশ খানিকটা দূরে পাহাড়ের ছায়া মেখে কালচে হয়ে আমাদের সামনে স্থির। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদকে ধরার ফাঁদ পাতা তার সৌন্দর্য্য যেন হিংসা, দ্বেষ, দাবি, সংগ্রামের উর্ধ্বে ওঠা প্রকৃতির কোনও প্রাচীন নিঃশ্বাস।
মিশন ডাল
কেনারামদার কথামতো চটজলদি স্নান সেরেই ডাইনিংয়ে চলে এলাম। ডাল, ভাত, আলুভাজা, আলু-পটল কারি, মাছ, চাটনি, পাঁপড় দিয়ে তৃপ্তি করে খেয়ে গুটিগুটি পায়ে আমরা হাঁটা লাগালাম সেই রহস্যময় ডালের দিকে। ঠান্ডা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, খুব একটা ভয়ঙ্কর নয়। তবে ফিনফিনে একটা হাওয়া কানে মৃদু ঝাপটা মারছে। এখানে সন্ধ্যা নামে দেরিতে। সেই সুযোগে বিকেল চারটেয় আমারা উঠে পড়লাম রঙিন শিকারায়। বারো জনের দল তিনটি শিকারায় ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ল অজানার উদ্দেশ্যে।
গাগরিবাল, লাকুতি ডাল ও বড়া ডাল নিয়ে গড়ে উঠেছে এই দীর্ঘকায় লেক। দৈর্ঘ্যে প্রায় আট কিমি এবং প্রস্থে প্রায় চার কিমি। ডালের একপাশে শঙ্করাচার্য পাহাড় এবং অন্যদিকে হরি পর্বত গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। কিছুটা এগোতেই দেখলাম, লেকের জলে সারি সারি অপেক্ষারত রাজকীয় সব হাউসবোটে থমকে ইতিহাস। কোন কোন নৌকা পুরনো ও নতুন হিন্দি সিনেমার (কাশ্মীর কী কলি থেকে জব তক হ্যায় জান) শুটিংয়ের জন্য খ্যাত, শিকারার চালক হামিদ ধৈর্য সহকারে তা আমাদের দেখালেন।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর বন্দিবাসের স্মৃতি বিজড়িত গাগরিবাল দ্বীপ, চারটি বড় চিনার গাছকে ঘিরে তৈরি চার-চিনার দ্বীপ দেখলাম শিকারা থেকেই। বহুল প্রচলিত, অতীতে এই চিনার গাছের পাতাতেই প্রাণের মানুষকে মনের কথা লিখে পাঠাতেন রাজা-বাদশা-রানি-বেগমরা। সেই চল এখনও ভূস্বর্গের ধমনীতে প্রবাহমান। শত অস্থিরতার মধ্যেও আন্তরিকতা আজও যেখানে অকৃত্রিম।
শিকারায় ভাসতে ভাসতেই দেখে নিলাম সৌন্দর্য্যে ভরপুর কবুতরখানা দ্বীপ, জলে ভাসমান মিনা বাজার। চাইলে সেই বাজার থেকে সস্তায় কিনে নেওয়া যায় এক-দুইখানি শীতাবরণ। এক কোণে সবজি মার্কেটও জল ভেঙে বিকিকিনি, দরদাম চলছে সমানে। কেউ আবার শিকারাতেই খাবার, আতর, প্রসাধনী সাজিয়ে ভাসতে ভাসতে হাজির অতিথিদের খিদমতে। তারই পাশ দিয়ে ডিঙি ঠেলে স্কুল থেকে বাড়ির পথে লাল টুকটুকে ছোট্ট মেয়ে। ওই দূরে ভাসমান কোনও মহল্লায় তাঁর গন্তব্য। যেখানে সকাল-সন্ধ্যায় এখনও শোনা যায় ভালোবাসার গান, ভোরের আজান। সেসব দেখে মনে হচ্ছিল, হারিয়ে গেছি আমি।
মাটিতে ফেরা
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। তীরে ভিড়লো আমাদের শিকারা। জল বিহার শেষে মাঝি হামিদ ও তাঁর সঙ্গীদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে দেখি, কেনারামদা (আমাদের ট্যুর গাইড) দাঁড়িয়ে। তাঁর সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোটেল। সেখানে কফি, পকোড়া সহযোগে সান্ধ্য-ভোজন ও নাচ-গান-গল্প-আবৃত্তি-আড্ডা চলল জমিয়ে। বাইরে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকল ঠান্ডা। চিকেন, রুটি, মিষ্টি দিয়ে রাতের খাবার সেরে লেপের উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধা পড়তেই হল।
কথায় বলে মেষ পালকদের হাসি কখনও চওড়া হয় না। তবে তাদের এক পলকের লজ্জা মাখা হাসির মধ্যে থাকে অপার পাহাড়ি রহস্য। সৃষ্টিকর্তার খেয়ালে তাই হয়তো তাদের সাকিন ভূস্বর্গের হৃদয়। দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গ কে-ই বা দেখেছে। সেই স্বর্গ যখন খোদ পৃথিবীতে নেমে আসে, তখন আর আক্ষেপ কীসে! সুন্দর এখানে ভয়ঙ্করী। পীরপাঞ্জাল গিরিশ্রেণির কোলে তার ঠাঁই। চির নতুন কাশ্মীরের মায়াবী রূপ প্রকৃতই ভুলিয়ে দেয় বিশ্ব ভুবন।
কিছু কথা
এ যেন আকাশ অমৃতদান করেছে কাশ্মীরের মুখে। নানান কিংবদন্তী আছে এই উপত্যকাকে ঘিরে। ফিরে যেতে হবে পুরাকালে। রামায়ণ-মহাভারতে কাশ্মীর উপাখ্যান পাওয়া যায়। মৌর্য সম্রাট অশোক, কুষাণরাজ কণিষ্ক এবং হিউয়েন সাং-এর পদাঙ্কের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ভূস্বর্গ। কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী' কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটেই রচিত বলে মনে করা হয়। পরবর্তীতে দুর্ধর্ষ মোঘল ও প্রবল ইংরেজদের রাজত্বের নিশানও রয়েছে কাশ্মীরের আনাচে-কানাচে। এত হাত বদলের পরেও ভূস্বর্গের রূপে কিন্তু এতটুকু মরচে ধরেনি। কাশ্মীর এখনও প্রত্যেকেরই আনন্দনিকেতন।
(প্রথম কিস্তি)