অ্যান্টনি কবিয়ালের স্মৃতিবিজড়িত ফিরিঙ্গি কালীমন্দিরে আজও সর্বধর্মসমন্বয়ের পুজো হয়
ধর্মভীরু বাঙালি বিধবা সৌদামিনীকে পত্মীরূপে গ্রহণ করার পরই তাঁর অনুপ্রেরণাতেই অ্যান্টনি কবিয়াল বউবাজার এলাকায় ওই সিদ্ধশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
'সত্য বটে আমি জেতেতে ফিরিঙ্গি, ঐহিকে লোক ভিন্ন ভিন্ন অন্তিমে সব একাঙ্গি।' আজও অ্যান্টনির গলায় কবিগানের সেই সুরমুর্চ্ছনা ছড়িয়ে রয়েছে ফিরিঙ্গি কালী মন্দিরের পরতে পরতে। জন্মসূত্রে খ্রিস্টান হলেও হিন্দুধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন পর্তুগিজ ব্যবসায়ী হেনসম্যান অ্যান্টনি। নিজের ধর্ম ত্যাগ না করেও বাংলা শিখে, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
ভোলা ময়রা, ঠাকুর সিংহ, হরু ঠাকুরের মতো প্রখ্যাত কবিয়ালের উপস্থিতিতেও কবিয়াল হিসেবে অ্যান্টনি হয়ে উঠেছিলেন অত্যধিক জনপ্রিয়। তিনি যে দেবী সিদ্ধেশ্বরীর কৃপা দৃষ্টি লাভ করেছিলেন। কথিত আছে, ধর্মভীরু বাঙালি বিধবা সৌদামিনীকে পত্মীরূপে গ্রহণ করার পরই তাঁর অনুপ্রেরণাতেই অ্যান্টনি কবিয়াল বউবাজার এলাকায় ওই সিদ্ধশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি প্রতিষ্ঠিত সেই কালী মূর্তিই ফিরিঙ্গি কালী নামে আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।
প্রচলিত আছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সঙ্গে ভোলা ময়রার কবিগানের লড়াই হয়েছিল এই মন্দির প্রাঙ্গনে। ফিরিঙ্গি কালী শুধু হিন্দু নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছেও জাগ্রত। ইংরেজ আমলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরাও এসে এখানে পুজো দিতেন। আজও ধূমধাম করে ফিরিঙ্গি কালীর পুজো হয়ে আসছে। দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার পূণ্যতিথিতে সেজে ওঠে ফিরিঙ্গি কালী। আজও এই কালীর মহিমা অপার। জাতপাতের বিভেদ ভুলে ভক্তদের ভিড়েও তাই জমজমাট হয়ে ওঠে দক্ষিণাকালী পুজোর রাতের এই ফিরিঙ্গি কালী মন্দির।
তবে ফিরিঙ্গি কালীর প্রতিষ্ঠা নিয়ে অন্যমতও প্রবল। অ্যান্টনি কবিয়াল নিত্য এই মন্দিরে আসতেন বলে কালেভদ্রে এই কালী মন্দির ফিরিঙ্গি কালী বলে প্রচারিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রতিষ্ঠা আরও আগে বলেই বিশ্বাস একাংশ ভক্তমণ্ডলীর। অনেক ইতিহাসবিদও তাই মনে করেন। আজ থেকে পাঁচশো বছরেরও আগের কথা। তখন গঙ্গা বয়ে চলেছে আজকের বউবাজার অঞ্চলের ওপর দিয়ে | গঙ্গার পাশেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে একটি ছোট্ট একচালা কুঁড়েঘরে থাকতেন শ্রীমন্ত পণ্ডিত নামে এক তন্ত্রসাধক।
তিনি
সদাই
দেবী
শক্তির
আরাধনায়
নিয়ত
থাকতেন।
জঙ্গলেই
তিনি
প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন
শিব
ও
কালীর
মূর্তি।
সেটা
ছিল
আনুমানিক
১৪৩৭
সাল।
আজও
মন্দিরের
গায়ে
খোদাই
করা
স্থাপিত
সন
৯০৫।
ওই
সাল
বঙ্গাব্দ
ধরলে
পাঁচ
শতাধিকই
হয়
মন্দিরের
বয়স।
কিন্তু
কী
করে
ফিরিঙ্গি
কালী
হয়ে
উঠল
শ্রীমন্ত
পণ্ডিত
প্রতিষ্ঠিত
ওই
মন্দির?
জব
চার্নক
কলকাতা
তরী
ভিড়িয়েছেন।
তিনি
ওই
অঞ্চলে
আসার
পর
থেকে
ফিরিঙ্গিদের
বসবাস
বাড়তে
লাগল
এলাকায়।
সেইসময় এলাকায় বসন্ত রোগ ছড়ায়। ফিরিঙ্গিরাও আক্রান্ত হন দুরারোগ্য এই ব্যাধিতে। তখন তাঁরা শ্রীমন্ত পণ্ডিতের শরণাপন্ন হন। বসন্ত রোগের চিকিৎসা করাতে এসে আরোগ্য লাভের জন্য দেবী মায়ের পুজোও দিতে থাকেন তাঁরা। তারপরই ধীরে ধীরে লোকমুখে এই কালীর প্রচার। আর ফিরিঙ্গি সাহেবদের মুখে মুখে এই কালী মায়ের প্রচার হেতুই ফিরিঙ্গি কালী মন্দির নামে পরিচিতি পায় বউবাজার এলাকার বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের এই কালী মন্দির।
তারপর এই মন্দিরে এসেই কবিত্বলাভ করেন অ্যান্টনি হেনসম্যান। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় অ্যান্টনি কবিয়ালের নামও। মন্দিরের মূল বিগ্রহ ত্রিনয়নী মৃন্ময়ী সিদ্ধেশ্বরী কালী। রয়েছে শিব, দুর্গা, শীতলা, মনসা, গনেশ, রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি মূর্তি। এখানে অমাবস্যায় মহানিশি পুজো হয়, হয় অন্নকূট ভোগ। তবে বলির প্রথা নেই।