৫ই জানুয়ারি: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ-বিএনপি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার দায় কার ছিল
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে দশম সংসদ গঠিত হলেও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্জন, ব্যাপক সহিংসতা এবং বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে দেশটির নির্বাচনের ইতিহাসে এটি এখন পর্যন্ত বহুল বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর একটি।
ওই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের তিনশো' আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল, ফলে বাংলাদেশের মোট ৯,১৯,৬৫,৯৭৭ ভোটারের মধ্যে কাগজে-কলমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো ৪,৩৯,৩৮,৯৩৮ জন।
তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতে, নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে খুব কম ভোটারই ভোট দিয়েছিলেন।
যেসব এলাকায় নির্বাচন হয়েছে সেখানেও বিএনপির বয়কট, কম ভোটার উপস্থিতি এবং নানা ধরণের অনিয়মের অভিযোগের কারণে নির্বাচনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন ভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদল বিএনপিকে এক টেবিলে আনা বা নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার উদ্যোগ নিলেও সেটি সফল হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানালেও তারা সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি, বরং বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করলে সহিংসতাপূর্ণ ও বিতর্কিত সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতে, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়নি, কারণ তারা মনে করেছেন যে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখে নির্বাচনে যাওয়া কিংবা না-যাওয়া ছিলো সমান।
"তাদের (আওয়ামী লীগ) পয়েন্ট ছিলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার থাকবে, আর আমাদের পয়েন্ট ছিলো সরকার হতে হবে নিরপেক্ষ," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিস্টার হোসেন।
অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন যে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা সফল হোক সেটাই বিএনপি চায়নি, কারণ তারা তখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের বিচার মেনে নিতে পারেনি।
"আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে সংলাপ বা সমঝোতা সফল না হওয়ার জন্য বিএনপির এই মনোভাবই প্রধানত দায়ী ছিলো," বলছিলেন তিনি।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
১৯৭ কেন্দ্রে শতভাগ, হাজারো কেন্দ্রে ৯৫-৯৯% ভোট
ভোট ও আন্দোলন নিয়ে কৌশল ঠিক করতে টানা বৈঠক শুরু করছে বিএনপি
বাংলাদেশের ইতিহাসে মোড় ঘোরানো ১৪টি ঘটনা
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
রাজনৈতিক সংকটের শুরু হয়েছিল সরকার সংবিধানে একটি সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেয়ার পরপই।
সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১১ সালের মে মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। যদিও গণমাধ্যমের খবরে আদালতকে উদ্ধৃত করে বলেছিলো যে, 'শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে'।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে নির্বাচন নিরপেক্ষ করার যুক্তি দেখিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল।
আদালতের রায়ের পর ২০১১ সালের জুনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হয়, যার তীব্র বিরোধিতা আসে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর দিক থেকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন যে বাংলাদেশে সেই সময়কার রাজনীতি এবং নির্বাচন নিয়ে সংকটের শুরুই হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাকে কেন্দ্র করে।
"এটি না হলে নির্বাচন নিয়ে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না," বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
মূলত এরপর থেকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এমন বক্তব্য আসতে থাকে দলটির তরফ থেকে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিলো এমন: শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই নির্বাচনকালীন সরকার হবে এবং সেটি মেনেই নির্বাচনে আসতে হবে বিএনপিকে।
পাঁচই জানুয়ারিরি নির্বাচনের আগে যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল. তাতে যোগ দিয়েছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় অফার করা হয়েছিলো কিন্তু সেটি গ্রহণ না করে তারা নির্বাচন ঠেকিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলো তাদের জোট সহযোগী জামায়াতের কারণে। সে কারণেই আলোচনা সফল হয়নি"।
বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য বলছেন যে সরকার বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে নিয়ে নির্বাচনটিকে বৈধতা দিতে চেয়েছিলো। "আমরা এখনও মনে করি বর্জনটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো"।
মধ্যস্থতা, সংলাপ, হাসিনা-খালেদা ফোনালাপ ফাঁস
লাগাতার অবরোধ, নাশকতা আর সহিংসতার মধ্যেই ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাধারণ নির্বাচন।
এই নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট।
ভোট গ্রহণের আগের রাতেই সারাদেশে পাঁচশো'র মতো ভোটকেন্দ্রে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়াকেই এসব সহিংসতার মূল কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। মূলত তখন থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছিলো।
২০১৩ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপের প্রস্তাব দেন।
একদিন পরেই মতিঝিলের এক সমাবেশ থেকে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি সরকারকে তার দাবি পূরণে ৪৮-ঘণ্টার একটি আল্টিমেটাম দিলে মুখোমুখি হয়ে ওঠে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল।
এমন পরিস্থিতিতে দশম সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার জন্য একটি উদ্যোগ এসেছিলো জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের দিক থেকে।
জাতিসংঘের চেষ্টা
তার দূত হিসেবে ২০১৩ সালের জুনে ঢাকায় আসেন অস্কার ফার্নান্দোজ তারানকো। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি দলের নেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন৷
তার মধ্যস্থতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদল বিএনপির শীর্ষ নেতারা আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছিলেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন নিজেও টেলিফোনে কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার সাথে। দুই নেত্রীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতারা তখন জানিয়েছিলেন যে বান কি মুন দুই নেত্রীকে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়৷
পরে সে বছর অক্টোবরেই মিস্টার তারানকো ফোনে আবার কথা বলেন আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাথে।
সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনের জন্য এমন নানা উদ্যোগ দৃশ্যমান ছিলো সে বছর নভেম্বরের শেষ দিকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও। যদিও ২৫শে নভেম্বরের সেই রাতেই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে মিস্টার আলমগীর ভোটের আগে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার দাবি জানিয়েছিলেন।
মূলত তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরাও বিভিন্ন দলের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করছিলেন এবং পর্দার অন্তরালে দুই প্রধান দলের নেতাদের মধ্যেও বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার খবর আসছিলো।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দু'দলের ওপরই চাপ তৈরি করেছিলো আলোচনায় বসার জন্য। যদিও উভয় দলের অনমনীয়তার কারণেই সেটি শেষ পর্যন্ত কোন ইতিবাচক ফল আনতে পারেনি"।
আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উল হানিফ বলছেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও খালেদা জিয়াকে ফোন করেছিলেন এবং জবাবে, তার ভাষায়, 'অশোভন' আচরণ করেছিলেন খালেদা জিয়া।
"খালেদা জিয়াকে ফোন দেয়া ছাড়াও নির্বাচনকালীণ সরকারেও বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। কিন্তু তারা সেগুলোতে ইতিবাচক সাড়া দেননি। ফলে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার সব দায় তাদেরকেই নিতে হবে," বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার সেই ফোনালাপ অবশ্য পরে ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তুলেছিলো।
এসব নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে বিএনপি না আসায় ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান, কারণ এসব আসনে অন্য কোন প্রার্থী ছিল না৷ আর নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। ৩৩টি আসন পেয়ে বিরোধী দল হয় জাতীয় পার্টি, যাদের ২০ জন প্রার্থীও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলো।
তবে অর্ধেকের বেশি আসনে নির্বাচন না হলেও যেসব এলাকায় নির্বাচন হয়েছে, তার বেশিরভাগ জায়গায় সহিংসতার কারণে কিংবা অনেকটা একতরফা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ভোটকেন্দ্র্রে যাননি বহু ভোটার।
"সেবার কেন্দ্রে যাওয়ার সাহসই পাইনি, ভোট দেয়া তো দূরের কথা," ৫ই জানুয়ারির ভোটের দিনের কথা স্মরণ করে বলছিলেন ঢাকার একটি আসনের ভোটার সালমা বেগম।
আর বরিশালের স্কুল শিক্ষক মিনারা খাতুন বলেছেন, "আমার বাসার কাছেই একটি কেন্দ্র ছিলো। অনেক গণ্ডগোল হয়েছিলো। এটুকু মনে আছে"।
সমঝোতা না হওয়ার কয়েকটি কারণ:
পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনের আগের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন এমন কয়েকজন নেতা এবং কয়েকটি সিভিল সোসাইটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সাথে কথা বলে নির্বাচনের আগে সমঝোতা না হওয়ার যেসব কারণ পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে:
১. দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীর ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব অর্থাৎ তারা দু'জনই রাজনৈতিক খেলায় শুধু জিততে চেয়েছিলেন
২. শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখেই নির্বাচন- আওয়ামী লীগের এই অনমনীয় মনোভাব
৩. শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান হিসেবে কোনভাবেই মানবো না- বিএনপির এই অনমনীয় মনোভাব
৪. বিএনপি'র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের জোট-সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব
৫. বিএনপি'র কোন কোন নেতা মনে করেন যে প্রভাবশালী একটি দেশের ভূমিকা ছিলো বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার বিষয়ে। তাদের মতে, এ কারণেই তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিলো সরকার।
৬. বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে সরকার অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছিলো যে বর্জন করলেও নির্বাচন বানচাল করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না।