আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আন্দোলনের ইতিহাস জানেন কি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আন্দোলনের ইতিহাস জানেন কি
২১ ফেব্রুয়ারি ফি বছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তথ্যটি হয়তো অনেকেই জানেন। তবে এই দিনটির পিছনের ইতিহাস হয়তো অনেকের অজানা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানাবিধ ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে একসূত্রে গেঁথে তুলতে রাষ্ট্রপুঞ্জ এমন একটি দিনের প্রচলন শুরু করেছে যা সত্যি তারিফ করার মতো। এই দিনটিকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ হিসেবে তা জানাটা অত্যন্ত আবশ্যক।
আন্দোলন পুঞ্জীভূত
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলাদেশ তথা এপার বাংলাতেও ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। ভাষাকে কেন্দ্র করে এক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। যা বর্তমানে বাংলাদেশে নামে পরিচিত। আর সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাঙালি জাতি। সেই লড়াইকে জয় করেই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কতিপয় কয়েকজন বাঙালি।
কোন দাবি পেশ
ঘটনা হল ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের ঠিক একমাস পরেই ১৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি ওঠে। উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সংসদে একটি বিবৃতি দেওয়া হয় বিরোধী দলগুলির তরফে।
কেন আন্দোলন
তারপরেই ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলি জিন্না সরাসরি সেই দাবিকে নস্যাৎ করে দেন। এবং জানান পাকিস্তানে উর্দু ছাড়া আর কোনও ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। এবং যারা এই ধরনের দাবি তুলবেন তাঁদের এদেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করা হবে।
শুরু ভাষা আন্দোলন
সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে ভাষাকে কেন্দ্র করে ধিকধিক করে আগুন জ্বলতে শুরু করে। পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও পাকিস্তান বিরোধিতায় ধীরে ধীরে গলা ফাটাতে শুরু করে জনতার একটি অংশ। যার ঠিক চার বছর পরে ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যাস, তারপর থেকেই ঢাকা শহরে আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। মিটিং-মিছিল সবই পরপর চলতে থাকে।
রণক্ষেত্র ঢাকা
ঢাকা শহর কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল ছাত্রছাত্রীরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। এবং এই বিক্ষোভ আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই পাঁচ জন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হযন। তারা ছিলেন মহাম্মদ সালাউদ্দিন, আবদুল জব্বর, আবুল বরকত, রফিকুদ্দিন আহমেদ ও আবদুস সালাম।
মিলল মর্যাদা
এদের আত্ম বলিদানের পরেই পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এবং ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান পাস হয়, যেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রপুঞ্জে দাবি
এই ঘটনা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে কানাডাবাসী রফিকুল ইসলাম নামে এক বাঙালি রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব উত্থাপিত হলে প্রায় সমস্ত দেশের সম্মতিক্রমেই তা স্বীকৃত হয়। এবং ১৯৯৯ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি
এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। এবং যার দেড় দশকের মধ্যেই পাকিস্তানের শাসনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্ব মানচিত্রে।