লাদাখ সীমান্তে শান্তি ফিরবে জয়শঙ্কর-ওয়াং বৈঠকের পর? নির্ভর করছে একজনের উপর!
১৯৮১ সালের ২৯ জুন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন চিনের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী হুয়াং হুয়া। সেই সাক্ষাতের সময়ই দুই জন মেনে নেন যে যতদিন না দুই দেশের সীমান্ত বিবাদ মিটছে, ততদিন দুই দেশের বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। সেই বৈঠকের ৩৯ বছর পর মস্কোতে ভারত-চিন বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকে ফের উঠে এল সীমান্ত বিবাদের বিষয়টি।
১৯৫৯ সালের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা
বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন ১৯৫৯ সালে তৎকালীন চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রিন লাইনে ফিরে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চিন। গত কয়েক দিনে একাধিকবার ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় চিনা সেনা। আর এরই মাঝে প্যাংগং হ্রদের উত্তর তীরে ফিঙ্গার ৫-এর সামনে গোপনে নির্মাণ কাজ জারি রেখেছে চিনা সেনা। এই বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানান ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এদিন মস্কোর বৈঠকে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, এপ্রিল পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থা ফেরাতে হবে চিনকে।
জয়শঙ্কর এবং চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াংয়ের বৈঠক
পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ওয়াই গতকাল রাতে মস্কোয় মুখোমুখি বৈঠকে বসেন। বৃহস্পতিবার সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে অংশ নিয়ে জয়শঙ্কর ও ওয়াং ওয়াই লাদাখ ইস্যুতে বিস্তারে আলোচনা করেন বলে জানা যায়।
এলএসি সীমা নিয়ে চিনা দাবি
চিনা সেনা ফিঙ্গার ৪ থেকে ফিঙ্গার ৮-এর মধ্যে ৮-কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাজুড়ে তাদের তৈরি কাঠামোগুলিকেই এলএসি বলে দাবি করে যাচ্ছে এখনও। লাদাখের প্যাংগং হ্রদের কাছে গ্রিন টপের উপর থেকে চিনা সেনা দখলদারি সরাতে না চাওয়াতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তিক্ত হচ্ছে চিনের। প্যাংগং সোতে চিনা সেনারা ফিঙ্গার ৫ এ ফিরে এসেছিল, তবে তারা এখনও ফিঙ্গার ৪-এর রিজলাইন দখল করে রয়েছে। আর এই পুরো বিষয়টাই হচ্ছে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে।
চিনের সেনা বৃদ্ধি প্যাংগংয়ে
১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিন সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হন। তারপর থেকেই উত্তেজনার আবহ রয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর। এরপরেও ৭ সেপ্টেম্বর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে লাদাখ৷ রাতে দুই পক্ষের তরফেই গুলি ছোড়া হয়। চিনা সেনার হামলার জবাব দেয় ভারত। যদিও চিনের দাবি, ভারতের তরফ থেকেই প্রথম হামলা চালানো হয়। যদিও চিনের এই অভিযোগ উড়িয়ে ভারতীয় সেনার দাবি, বিনা প্ররোচনায় চিনা আর্মি গুলি চালাতে শুরু করে। যেভাবে মাস কয়েক আগে ভারতীয় সেনার উপর হামলা চালিয়ে ছিল চিন, সেভাবেই তারা হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু, ভারতীয় সেনা দক্ষতার সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করে।
লাদাখে শান্তি স্থাপন হবে কি?
সোমবার রাতের গুলির চলার পর থেকেই প্যাংগং লেকের উত্তর দিকে সেনা মোতায়েন শুরু করেছে চিন৷ এমনকী মঙ্গলবার একটি ছবি সামনে আসে। তাতে দেখা গেছে, চিনের সেনা জওয়ানরা হাতে লাঠি-ছোরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারও কারও পিঠে রাইফেলও রয়েছে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি শান্ত করা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন হবে কি না, তা পুরোপুরি নির্ভর করছে শি জিনপিংয়ের উপর৷
দ্বিপাক্ষিক স্তরে বৈঠক হয় জয়শঙ্কর-ওয়াংয়ের
গতকাল ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পর দ্বিপাক্ষিক স্তরেও বৈঠক হয় চিন ও ভারতের। সীমান্তে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘ রাত পর্যন্ত আলোচনা চলে। বৈঠকের শেষে কোনও দেশের তরফেই সরকারিভাবে কোনও বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি। সূত্র অনুযায়ী, জয়শঙ্কর ও ওয়াংয়ের বৈঠকের মূল বিষয় ছিল লাদাখ। লাদাখ সীমান্তে পরিস্থিতি শান্ত করা এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় সেনা সরানোর বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। লাদাখ সংঘর্ষ আবহে এই প্রথম মুখোমুখি জয়শংকর এবং ওয়াং।
চিনের ১৯৬২ সালের মনোভাবের পুনরাবৃত্তি
ইন্দো-চিন সীমান্তে উত্তেজনা ৪ মাস পরেও অব্যাহত। একদিকে যেমন লাদাখ সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে চিন সমারাস্ত্র মজুত করছে। তেমন ভাবেই ভারতও লাদাখ, সিকিম সহ ইন্দো-চিন সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর বাড়তি সেনা মোতায়েন করছে। ফলে উত্তেজনা কয়েকগুন বেড়েছে এলএসি-তে। আর এর কারণ চিনের ১৯৬২ সালের মনোভাব। উল্লেখ্য বিষয়, জিনপিং নিজেকে মাও জেদংয়ের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন।
এলএসি সমস্যার সূত্রপাত ১৯৫৯ সালে
অঞ্চলভিত্তিক অধিকারের জটিলতার জেরে উভয় দেশই ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে অল্প সময়ের জন্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাতে তাদের সমস্যার কোনও নিষ্পত্তি হয়নি এবং এর অন্তত সাত দশক পরও সম্পর্কে সেই অস্বস্তি চলছে। সমস্যার সূত্রপাত ১৯৫৯ সালে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি লিখে এলএসি নিয়ে তাঁদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সীমান্তের কথা বলেন চিনা প্রধানমন্ত্রী এনলাই। যদিও ভারত তা অস্বীকার করেছিল।
কী করবেন জিনপিং?
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে চিনে প্রিমিয়ার লি পেং যখন ভারত সফরে আসেন, তখন পিভি নরসিমহা রাও এলএসি-র এই মত মেনে নেন। পরে ১৯৯৩ সালে বেজিংয়ে গিয়ে এই সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পিভি নরসিমহা রাও। তবে ভারতের পক্ষ থেকে কোনও দিনও এলএসি-র মানচিত্র অদলবদল করা হয়নি। এরপর ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন এই সংক্রান্ত বিবাদ মেটানোর প্রস্তাব করেন, তখন তা প্রত্যাখ্যান করেছিল বেজিং। এখন লাদাখে শান্তি ফেরাতে প্রয়োজন জিনপিংয়ের মনস্থির করা। একমাত্র তাহলেই চিনা সেনার আস্ফালন কমবে সীমান্তে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপযুক্ত সম্মান প্রাপ্য, আস্ত আর্টিকেল লিখে ফেলল এক রোবট!