সোমনাথ ভারতী 'আঁফাঁ তেরিবল', অরবিন্দ কেজরিওয়াল যেন 'ধৃতরাষ্ট্র'
দিল্লির আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতীকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি পাক্কা 'আঁফাঁ তেরিবল' হয়ে উঠেছেন। তাঁর আচরণে আম আদমি পার্টি বিব্রত হয়েছে চরম। অথচ 'অন্ধ স্নেহের' বশবর্তী হয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁকে কিছু বলছেন না বা বলতে চাইছেন না। বরং ওঁর পক্ষ নিয়ে গত দু'দিন ধরে দিল্লিতে যে কাণ্ডটা করলেন, তা কেবল সার্কাসের সঙ্গে তুলনীয়।
ঘটনার শুরু গত ১৫ জানুয়ারি রাতে। তার আগের দিন দিল্লিতে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন এক ড্যানিশ তরুণী। দেহব্যবসা এবং মাদক সেবনের জেরে যৌন অপরাধ বাড়ছে, এই দাবি করে সোমনাথ ভারতী দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন 'সমাজবিরোধী' ধরতে। খিরকি এক্সটেনশন এলাকায় একটি বাড়িতে উগান্ডা এবং নাইজেরিয়ার কিছু নাগরিক ছিলেন। অভিযোগ, ওঁরা অসামাজিক কাজকর্মে জড়িত দাবি করে তিনি পুলিশকে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দেন। পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ সেই কাজ করতে রাজি হয়নি। একে 'ঔদ্ধত্য' ধরে নিয়ে দিল্লি পুলিশের মুণ্ডুপাত করে হইচই শুরু করেন সোমনাথ ভারতী। পরে রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করে দেন স্বয়ং অরবিন্দ কেজরিওয়ালও।
আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতীর আইনি কাণ্ডজ্ঞান কতটা, তা নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি, ১৯৭৩) ৪১(১)(এ) ধারা অনুযায়ী, পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ তখনই গ্রেফতার করতে পারবে, যদি মনে হয় সংশ্লিষ্ট কাজটি 'কগনিজেবল অপরাধ' বা অভিযোগ যুক্তিযুক্ত (রিজনেবল) বা গ্রেফতার করার আগে বিশ্বাসযোগ্য (ক্রেডিবল) তথ্যপ্রমাণ মিলেছে বা যুক্তিযুক্ত সন্দেহ (রিজনেবল সাসপিশন) রয়েছে। পুলিশ মনে করেছিল, সোমনাথ ভারতীর অভিযোগের যৌক্তিকতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
ভেরা বনাম রাজস্থান রাজ্য মামলায় (১৯৯৬) শীর্ষ আদালত বলেছিল, পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১ (১)(এ) ধারাটি পুলিশকে আবশ্যিকভাবে মানতে হবে। অর্থাৎ সোমনাথ ভারতী পুলিশকে বেআইনি কাজ করতে প্ররোচনা দিচ্ছিলেন। সংবিধানের ২১ ধারায় সবার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আইননির্দিষ্ট পদ্ধতি (প্রসিডিওর এস্টাব্লিশড বাই ল) ছাড়া কাউকে এ থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ভারতে থাকা বিদেশিরাও এই অধিকার ভোগ করেন। মন্ত্রী মশাই বোধ হয় এ সব জানেন না! তা ছাড়া, বিদেশিদের ঠুনকো সন্দেহের বশে গ্রেফতার করলে কূটনীতিক সম্পর্কে কী প্রভাব পড়ত, তাও ভেবে দেখার দরকার আছে বৈকি!
নিজের বেআইনি কাজের সাফাই দিতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার ড্যানিশ তরুণীর নামও বলে দিয়েছেন সোমনাথ ভারতী। 'বেআইন মন্ত্রী'-র জানা দরকার, ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ২২৮ (এ) ধারা অনুযায়ী, ধর্ষিতার নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করা যায় না। রামদেব সিং বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলায় (২০০৩) সুপ্রিম কোর্ট কড়া নির্দেশ দিয়েছিল, ধর্ষিতার নাম গোপন রাখতে হবে। তাই টিভি-তে ধর্ষিতার মুখ দেখানো হয় না, কাগজে ধর্ষিতার নাম ছাপা হয় না। ওই মামলায় শীর্ষ আদালত বলে, সংবিধানের ২১ ধারায় বর্ণিত জীবনের অধিকার শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকা নয়, বরং সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা। তাই ধর্ষিতার নাম গোপন রাখতে হবে, নইলে আইপিসি ২২৮ (এ) ধারা মোতাবেক, অন্তত দু'বছর কারাবাস এবং জরিমানা হবে! তা হলে, সোমনাথ ভারতী ছাড় পাবেন কেন? সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের দেশ পরিচালিত হয় সংবিধানের নির্দেশ মেনে। সোমনাথ ভারতী সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেও সংবিধানকে 'ছেঁড়া কাগজ' মনে করেছন!
খিরকি এক্সটেনশন এলাকার ওই বাড়িতে মহিলারাও ছিলেন। সেই দিন পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কোনও মহিলা পুলিশকর্মী ছিল না। অথচ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, মহিলাদের তল্লাশি করতে হবে শুধু মহিলা পুলিশকর্মী দিয়ে। গূঢ় অভিযোগ ছাড়া রাতে কোনও মহিলাকে গ্রেফতার করা যায় না। সেক্ষেত্রেও মহিলা পুলিশ থাকা বাঞ্ছনীয়। সোমনাথ ভারতীর এগুলি জানা আছে বলে মনে হয় না।
আইনের কচকচানি ছেড়ে এবার সাধারণ সৌজন্য নিয়ে একটু বলি। রেল ভবনের সামনে বিক্ষোভ চলার সময় সোমনাথ ভারতী বললেন, "বিজেপি মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। অরুণ জেটলির মুখে থুতু দেব।" এ কেমন কথা! অন্য দলের নেতার সমালোচনা আপনি করতে পারেন, স্বাভাবিক। কিন্তু এ কোন ধরনের রাজনীতিক সংস্কৃতি? আপনারা নাকি দেশকে শুদ্ধ করতে নেমেছেন। এটা যদি নমুনা হয়, তবে দেশের সামনে ঘোর বিপদ!
সোমনাথ ভারতী আরও বলেছেন, উগান্ডায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার দেহব্যবসায় যুক্ত। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় এটা সত্যি, তা হলে উনি গোপনে বিদেশ মন্ত্রকে অভিযোগ জানাতে পারতেন। সারা বিশ্বে এই বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে আখেরে তো দেশের মুখ পুড়ল। নাকি ওঁর ঘোলা জলে মাছ ধরার কোনও অভিপ্রায় আছে?
দুভার্গ্যজনক হল, এমন একটি ব্যক্তিকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল শুধু মদতই দিচ্ছেন না, জনসমক্ষে মন্ত্রীর হয়ে সাফাই গাইছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ভূমিকা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয়! ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য দৃষ্টিহীন ছিলেন। আর দৃষ্টি থাকতেও অরবিন্দ কেজরিওয়াল 'দৃষ্টিহীন' হয়ে বসে আছেন।