জনসেবার ‘ব্রত’ পালনে শীর্ষে থাকলেও সন্ধ্যা রায়কে 'ডুমুরের ফুল' বলে কটাক্ষ বিরোধীদের
নিতান্তই সরল, সাদাসিধে একজন ভালো মানুষ তিনি। রাজনীতি বলতে বোঝেন জনসেবার একটা সুযোগ মাত্র৷ অভিনয় জীবন শেষে মমতার হাত ধরে ভোট-বৈতরণী পার হলেও,মাত্র দু'বছরেই তিনি অনেকটা ‘অভিজ্ঞ' হয়ে উঠেছেন সাংসদ হিসেবে।
রাজনীতি বলতে বোঝেন জনসেবার একটা সুযোগ মাত্র৷ প্রথম সুযোগ পেয়েই বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের পিছনে ফেলে সাংসদদের এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকা খরচের খতিয়ানে ফার্স্ট হয়েছেন 'ফুলেশ্বরী' সন্ধ্যা রায়। কিন্তু এলাকা উন্নয়নে তাঁর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট।দু'বছরে প্রাপ্য সাংসদ কোটার ১০ কোটি টাকা এলাকা উন্নয়ন খাতে খরচ করে বাঘা জনপ্রতিনিধিদের চাপে ফেলে দিয়েছেন তিনি। তবু তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিরোধীরা।
'ডুমুরের ফুল' তকমা এই আড়াই বছরেই লেগে গিয়েছে তার গায়ে। এলাকার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না বলে বিরোধীদের অভিযোগ। শুধুই সাংসদ কোটার টাকা খরচ করা হয়েছে বিভিন্ন খাতে। দীর্ঘমেয়াদি কোনও উন্নয়ন পরিকল্পনার ছাপ নেই। এমনকী এলাকার সমস্যা নিয়ে মেদিনীপুরের সাংসদকে কোনওদিন সরব হতেও দেখা যায়নি সংসদে।
সাংসদ হওয়ার পর কী কী কাজ কাজ করেছেন
- এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট দীর্ঘদিনের। তাই প্রথমেই ডিপ টিউবওয়েলের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সাংসদ। পানীয় জলের জন্য গভীর নলকূপ বসানের কাজে বরাদ্দ করেছেন সাংসদ কোটার টাকা।
- সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিকাংশ স্কুলকেই বিভিন্ন খাতে অনুদান দিয়েছেন। বাদ যায়নি প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি।
- স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার প্রদান করেছেন। কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতেই তিনি তাঁর সাংসদ-এলাকায় কোনও স্কুলকেই প্রায় বঞ্চিত করেননি।
- ভেন্ডিং মেশিন বসিয়েছেন এলাকার বহু স্কুলে। রাজ্যের মধ্যে প্রথম মেদিনীপুরের স্কুলগুলিতে এই ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়।
- রাস্তার উন্নয়নে বরাদ্দ করেছেন সাংসদ কোটার একটা বৃহৎ অংশ। উল্লেখযোগ্য হল, দাঁতনের বৌদ্ধবিহার থেকে জাতীয় সড়ক সংযোগকারী রাস্তা।
- এলাকার বহু রাস্তা আলোকিতকরণ হয়েছে তাঁর সাংসদ কোটার টাকায়। এই পাঁচ বছরে যাতে কোনও রাস্তাই অন্ধকারে না ডুবে থাকে, তা নিশ্চিত করাই মেদিনীপুরের সাংসদের লক্ষ্য।
- এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দাই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। সেই কারণে সেচের জলের বন্দোবস্ত করেছেন তিনি। কৃষি জমিতে পাম্প বসানো হয়েছে।
- নির্মিত হয়েছে একাধিক সেতু। কেশিয়ারি-খড়গপুর-নারায়ণগড় সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মিত হয়েছে। এই সেতু নির্মাণ হওয়ায় তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হয়েছে।
- স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে এলাকায়। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য মোহনপুর স্লুইসগেট। এই স্লুইসের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চাষাবাদ বা সেচের কাজেও বিশেষ সুবিধা হবে।
- বৈদ্যুতিকীকরণেও জোর দেওয়া হয়েছে। যে সমস্ত এলাকায় বা বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, সেইসমস্ত এলাকায় অবিলম্বে বিদ্যুৎ পৌঁছতেও বরাদ্দ হয়েছে সাংসদ কোটার টাকা।
- লোকসভার দু'বছরের মেয়াদে সকল সাংসদই ১০ কোটি করে টাকা পান। সাংসদরা ওই টাকা নিজেদের ইচ্ছেমতো এলাকা-উন্নয়নে ব্যয় করতে পারেন। সাংসদদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ কার্যকর করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এক বছর পুরো টাকা খরচ না হলে তা তহবিলেই জমা থাকে। পরের বছর তা খরচ করা যায়। কিন্তু খতিয়ান বলছে, মেদিনীপুরের সাংসদ সন্ধ্যা রায় ১০০-র জায়গায় ১০৭ শতাংশ অর্থ খরচ করে এরই মধ্যে রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন।
কোন দিকটায় খামতি
- শুধু সাংসদ কোটার টাকা বরাদ্দই হয়েছে। প্রভূত উন্নয়নের রূপরেখা নেই সেই পরিকল্পনায়। আদতে কোনও বড় প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করা হয়নি।
- সুবর্ণরেখা ব্যারেজ নিয়ে বর্তমানে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। সংসদেও এ বিষয়ে একটিবারও আলোচনা হয়নি। থমকে আছে পুরো প্রকল্পটি।
- মেদিনীপুর-খড়গপুর ডবল লাইন আজও বিশ বাঁও জলে। গিরি ময়দান স্টেশন পর্যন্ত কাজ এগিয়েছিল ডবল লাইনের। ২০১৪ লোকসভা ভোটের পর আর কোনও কাজ এগোয়নি। এলাকার সাংসদ তা নিয়ে সরব হননি।
- খড়গপুর সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের উন্নয়ন এতটুকু এগোয়নি। আড়াই বছর কেটে গিয়েছে, বাক আড়াই বছরের মেয়াদেও তা আদৌ হবে কি না সন্দেহ।
- নতুন কোনও ফ্লাইওভারের অনুমোদনও আনতে পারেননি জেলার জন্য। পুরনো পরিকল্পনাগুলো থমকে রয়েছে।
- এলাকায় বড় কোনও প্রকল্প আনতে তৎপর নন সাংসদ। সাংসদের আশু কর্তব্য লড়াই করে নিজের এলাকার জন্য প্রকল্প ছিনিয়ে আনা। এমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
কী বলছেন বিরোধীরা
একজন সাংসদ এলাকার জনপ্রতিনিধি। এলাকার মানুষ তাঁকে নিজেদের প্রতিনিধি করে সংসদে পাঠান। তাই তিনিই এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে এলাকাবাসীর দাবি সংসদে তুলে ধরেন। সেইমতো এলাকার উন্নয়নে সুচিন্তিত কোনও পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ আজ পর্যন্ত মেদিনীপুরের বর্তমান সাংসদের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি।
শুধু সাংসদ কোটার টাকা খরচ করে কাজের মানুষ বলে তকমা জোটালেই হবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রকল্প ছিনিয়ে আনতে হবে। যিনি এই কাজে বিশেষ পারদর্শী হবেন, এলাকার মানুষের সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরতে পারবেন, তিনিই বেশি সফল সাংসদ।
লোকসভা ভোটের প্রচারে মেদিনীপুর শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন সন্ধ্যা রায়। সকাল-বিকেল নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলতেন, 'আমি তোমাদেরই লোক। এ বার থেকে কলকাতার পাশাপাশি, মেদিনীপুর আমার নতুন ঠিকানা।' কিন্তু আদতে তা হয়নি। ভোটে জেতার পর কতবার মেদিনীপুরে গিয়েছেন, তা মনে করতেই পারছেন না এলাকার মানুষ। বিরোধীরা বলছেন, কথা রাখেননি সন্ধ্যা রায়। ভোটে জেতার পর থেকেই কলকাতাই তাঁর একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠেছে ফের।
বন্যাবিধ্বস্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার কোথাও একটি দিনের জন্যও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে যাননি সাংসদ। কেশিয়ারি বা দাঁতনের মানুষ মনে করেছিলেন তিনি আসবেন। কিন্তু আসেননি সন্ধ্যা রায়। জেলা তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও স্পষ্ট করে বলতে পারেননি, তাঁদের সাংসদ কোথায় আছেন।
সিপিআই নেতা প্রাক্তন সাংসদ প্রবোধ পাণ্ডা বলেন, আমরা বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। তাঁদের দুখে দুখী হয়েছি। তাঁদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছি। কষ্ট সহ্য করেছি একসঙ্গে।
কী বলছেন সন্ধ্যা রায়?
মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে আপ্লুত। মমতা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। মাত্র দু'বছর আগে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে আমার। নিতান্তই এই ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ আমি। কিন্তু আমি গ্রামের মেয়ে। সিনেমাতেও গ্রামের মেয়ের চরিত্রই বেশি করেছি। গ্রামের সমস্যাগুলো তাই অজানা নয়। সাংসদ হয়েই তাই ছকে ফেলেছিলাম, কী করব। সেইমতোই কাজ করেছি। জেলা প্রশাসনও সমস্তরকম সহযোগিতা করেছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বও।