সর্বশক্তি নিয়ে ডায়মন্ড হারবারে থাবা বসাতে উদ্যত বিজেপি, দুর্গ রক্ষার চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
সর্বশক্তি নিয়ে ডায়মন্ড হারবারে থাবা বসাতে উদ্যত বিজেপি, দুর্গ রক্ষার চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
ডায়মন্ড হারবার। তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুক। পরপর দুবার এই আসন থেকে জিতেই সাংসদ হয়েছেন তৃণমূলের যুবরাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেন, অভিষেক ডায়মন্ড হারবারকে খুব ভালোবাসেন। অন্য জায়গায় তাই দাঁড়াতে চান না। এমনকী ডায়মন্ড হারবার থেকে জিতে মানুষের পাশে থাকবেন বলে রাজ্যসভার সাংসদও হতে চাননি অভিষেক। তবে বিধানসভা ভোটে এই আসনটিতে থাবা বসাতে উদ্যত বিজেপি। জে পি নাড্ডার কনভয়ে হামলার অভিযোগে উত্তাল হয় রাজ্য-রাজনীতি। তারপর বিজেপি-র জেদ যেন বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। মমতার একদা সৈনিককেই 'ভাইপো'-গড়ে আঘাতের দায়িত্ব দিয়েছে বিজেপি।
কে কোথায় এগিয়ে, একুশের নির্বাচনের আগে ঝাড়গ্রামের সাত কেন্দ্রের হালহকিকৎ
তৃণমূলের প্রাক্তনী মুকুলই বিজেপির প্রধান স্থপতি, মমতার চিন্তা কমাতে পারছেন না পিকেও
অভিষেকের খাসতালুক
২০০৯ সাল থেকে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা আসনটি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। ২০০৯ সালে সোমেন মিত্র তৃণমূলের টিকিটে এই আসন থেকে সিপিআইএমের শমীক লাহিড়িকে হারিয়ে সাংসদ হন, ১,৫১,৬৮৯ ভোট পেয়ে। সেবার ৫৩.৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে দুইবার এখান থেকে জিতে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালে তৃণমূলের জয়ের মার্জিন কমে দাঁড়ায় ৭১,২৯৮, ১৩.২৫ শতাংশ কমে ভোটের হারও। ২০১৪ সালে তিনে থাকা বিজেপির শতকরা ভোটের হার বেড়েছিল ১২.৩৬ শতাংশ। তবে ২০১৯ সালে এই লোকসভা আসন থেকেই বিশাল ব্যবধানে (৩ লক্ষ ২০ হাজার ৫৯৪) জেতেন অভিষেক। তৃণমূল ৫৬.১৩ শতাংশ ভোট পায়। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের তুলনায় বিজেপির ভোট বাড়ে ১৭.৪৬ শতাংশ। বিজেপি প্রার্থী নীলাঞ্জন রায় ৩৩.৩৯ শতাংশ ভোট পান। সিপিআইএমের ভোট কমে ২৮ শতাংশ, কংগ্রেসের ৩.৬ শতাংশ। সিপিআইএম ও কংগ্রেসের ভোট বিজেপিতে গিয়েছে বলে দাবি তৃণমূলের। বিজেপির দাবি, কারচুপি না করলে এখানে চিত্র অন্যরকম হতেই পারত।
সিঙ্গুরের কংক্রিটের জঙ্গলে ফেরেনি সবুজ! শিল্প বনাম কৃষি একুশের ভোট-বাজারে
চাকা ঘোরাতে তৎপর বিজেপি
এবার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় তিন ধাপে ভোট হবে। শক্ত ঘাঁটিতে এভাবে এতো দফায় ভোট হওয়ায় অন্য গন্ধ পাচ্ছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীশূন্য করার লক্ষ্যে একদিকে ভোট লুঠের অভিযোগ, অন্যদিকে তার এক বছর বাদেই লোকসভা ভোটে প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়ায় এবার কোমর বেঁধে এই লোকসভা আসনের বিধানসভা ক্ষেত্রগুলি টার্গেট করছে বিজেপি। শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, আগের দলের নেত্রীর নির্দেশ মেনে অভিষেককে জিতিয়ে যে ভুল করেছিলেন, এবার তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। যদিও অভিষেক বা তৃণমূল দুর্গরক্ষায় আত্মবিশ্বাসী। ফলতার বিধায়ক তমোনাশ ঘোষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর শোভনের হাত ধরে ডায়মন্ড হারবারের বিধায়কের বিজেপিতে যোগদান ও টিকিট না পেয়ে ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা ছায়াসঙ্গী সোনালি গুহর দলত্যাগের ঘটনা তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়ায়। মাদার বনাম যুবর গণ্ডগোলের ঘটনাও বারবার প্রকাশ্যে আসে। অভিষেক ও তাঁর অনুগামীদের দাপটে অনেকেই কোণঠাসা বলে অভিযোগ। এই সবকে হাতিয়ার করেই ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের একাধিপত্যে থাবা বসাতে চাইছে বিজেপি। সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলের আলোকে নজর রাখা যাক এই লোকসভা আসনের বিধানসভা ক্ষেত্রগুলির দিকে।
ডায়মন্ড হারবার
২০১১ ও ২০১৬ সালের ডায়মন্ড হারবার বিধানসভা আসনে সিপিআইএম প্রার্থীকে ১৫ হাজারের বেশি ভোটে হারিয়ে বিধায়ক হন দীপককুমার হালদার। সম্প্রতি তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক সেরে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৯ সালে এই বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে সেই লিড বাড়িয়ে ভোট পেয়েছিলেন ১,০৯,১৩৪ এবং বিজেপি প্রার্থী নীলাঞ্জন রায় ভোট পান ৭৩,৬৭৩।
বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন শোভন-বৈশাখীর! একুশে ভোটের মুখে মহাধাক্কা পদ্মশিবিরে
ফলতা
২০১১ ও ২০১৬ সালে ফলতা থেকে বিধায়ক হন তৃণমূলের তমোনাশ ঘোষ। যদিও অভিষেকের দাপট বাড়ার পর থেকেই তাঁকে তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রে কাজ করতে দেওয়া হতো না বলে সেখানে যাওয়া তিনি ছেড়েও দিয়েছিলেন বলে অভিষোগ। তিনি গত বছর করোনায় প্রয়াত হন। তবে উপনির্বাচন আর হয়নি। এই বিধানসভা ক্ষেত্রে গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল ভোট পায় ১,১৪,৬৮৯। বিজেপি প্রার্থী পান ৭০,৯১২ ভোট।
সাতগাছিয়া
সাতগাছিয়া বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভোট পান ১,১১,৫৪০। বিজেপি প্রার্থী পান ৮৬,৭৬১ট ভোট। এই বিধানসভা আসন থেকে পাঁচবার জয়লাভ করেছেন জ্যোতি বসু। তাঁকে স্পর্শ করার সুযোগ ছিল সোনালি গুহর কাছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী ২০০১ সাল থেকে টানা চারবার এই আসন থেকে জিতে বিধায়ক হয়েছেন। তবে এবার তাঁকে প্রার্থী করেনি তৃণমূল। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বলেছেন, টিকিট চাই না। দলের হয়ে কাজ করতে চাই। অপমান, বঞ্চনার জবাব দিতে তিনি তৈরি হচ্ছেন।
বিষ্ণুপুর
গত লোকসভা ভোটে বিষ্ণুপুর বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ১,১৭,৬১৭ এবং ৭৩,৫২৯। তৃণমূলের ভোট বেড়েছিল, তবে বিজেপির বেড়েছিল অনেকটাই। ২০১৬ সালে এখান থেকে জিতে বিধায়ক হন দিলীপ মণ্ডল। তিনি পেয়েছিলেন ১,০৭,১২৯ ভোট, সিপিআইএম পেয়েছিল ৭৬,৪৯৯ ভোট। বিজেপি ২০১৬ সালে এই আসনে পেয়েছিল ১৪,২৬৪ ভোট। লোকসভা নির্বাচনে প্রায় তিন গুণ ভোট বাড়ার কারণ হিসেবেও উঠে আসে সিপিআইএমের ভোট বিজেপিতে যাওয়ার তত্ত্ব।
মহেশতলা
মহেশতলা আসনের দিকেও থাকবে নজর। ২০১১ ও ২০১৬ সালে এই বিধানসভা আসন থেকে জিতে বিধায়ক হন প্রাক্তন মন্ত্রী, মেয়র তথা বর্তমানে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা ও দমদমের ভোটের দায়িত্বে থাকা বিজেপি নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের শাশুড়ি কস্তুরী দাস। তাঁর প্রয়াণের পর ২০১৮ সালের উপনির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন মহেশতলার চেয়ারম্যান তথা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুর দুলাল দাস। এবারও তিনিই প্রার্থী। ২০১৯ সালে এই বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে অভিষেক ৯৮,০৯২টি ভোট পান, বিজেপি প্রার্থী পান ৬৯,২৫২টি ভোট।
বজবজ
বজবজ আসন তৃণমূলের আরেক শক্ত ঘাঁটি। ২০১৯ সালে অভিষেক এখান থেকে ভোট পান ১,১৯,৬৭৫টি। বিজেপি প্রার্থী পান ৬৩,১১৮। একদা সিপিআইএমের শক্ত ঘাঁটি বজবজে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে জিতে বিধায়ক হন অশোক দেব। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি তিনি এই কেন্দ্র থেকে টানা চারবার জিতছেন তৃণমূলের টিকিটে। এবারও তিনিই প্রার্থী। তবে ২০১১ সালে তিনি সিপিআইএম প্রার্থীকে হারিয়েছিলেন ৪৬ হাজারের বেশি ভোটে। ২০১৬ সালে নিকটতম কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাঁর জয়ের ব্যবধান কমে দাঁড়ায় প্রায় আট হাজারে। লোকসভা ভোটে এখানেও দুইয়ে ছিল বিজেপি।
মেটিয়াবুরুজ
সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কলকাতা লাগোয়া মেটিয়াবুরুজ সবচেয়ে বেশি লিড দিয়েছিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তৃণমূল এই বিধানসভা ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পেয়েছিল ১,১৯,৯৭৮টি ভোট। বিজেপি প্রার্থী পান ৩২,৮০২টি ভোট। সিপিআইএমের ফুয়াদ হালিম পান মাত্র ৯,২০১টি ভোট। এই আসনটি তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে জিতে বিধায়ক হন আবদুল খালেক মোল্লা। জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ১৮ হাজার। তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে এখানেও সিপিআইএমকে সরিয়ে দুইয়ে উঠে এসেছে বিজেপি।
ভোটের ফ্যাক্টর
লকডাউনে নিজের লোকসভা কেন্দ্রের বিপন্ন মানুষজনের জন্য দুই বেলা ঢালাও খাবারের বন্দোবস্ত করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল যুব কংগ্রেস এখানে খুব সক্রিয়। এতে আবার পুরানোর কোণঠাসা হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু দলবদলও হয়েছে। ফলে লোকসভা ভোটে সব বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও আমফান-পরবর্তী পরিস্থিতি, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও শোভন চট্টোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানো এবারের ভোটে ফ্যাক্টর হতে চলেছে। তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীর দল কতটা ভাগ বসাতে পারে তার উপর নির্ভর করছে এই লোকসভা আসনের বিভিন্ন বিধানসভা ক্ষেত্রের ভোটের ফলাফল।
মুকুল-শুভেন্দুদের বিরুদ্ধে জিততে মমতা-পিকের পঞ্চবাণ, একুশের ভোটে তৈরি রণকৌশল
শুভেন্দু যা বলবে তা-ই করবেন তৃণমূলের শিশির! মোদীর সফরের আগে জল্পনা তুঙ্গে
লোকসভা ভোটে মথুরাপুরের ৭-০ লিড বিধানসভা ভোটে ধরে রাখা কঠিন তৃণমূলের
{quiz_525}