‘হেমন্তদা’র জন্যই আনন্দমঠে ‘বন্দেমাতরম’ গেয়েছিলেন লতা, তারপর ইতিহাসে তাঁদের জুটি
‘হেমন্তদা’র জন্যই আনন্দমঠে ‘বন্দেমাতরম’গেয়েছিলেন লতা, তারপর ইতিহাসে তাঁদের জুটি
তখন সবে কলকাতা থেকে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বই) গিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ায় পা রেখেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না হওয়া সত্ত্বেও লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। সংস্থার পক্ষ থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে জানানো হয়েছিল আপনি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে গান গাওয়াতে পারেন আমাদের আপত্তি নেই। তা শুনেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সটান হাজির হয়েছিলেন লতার বাড়িতে।
আমি আপনার জন্যই গাইব, হেমন্তকে বলেছিলেন লতা
লতা মঙ্গেশকর তখন থাকতেন মুম্বইয়ের নানাচকে একটি ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম সাক্ষাৎ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছেন শুনেই লতা বলেন, আপনাকে আমি চিনি, নাম শুনেছি। প্রথম আলাপেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। লতা তখন বেস নামডাক করেছেন হিন্দি জগতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রস্তাব দিলেন তাঁকে ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে গান গাওয়ার জন্য। লতা শুনে জানিয়েছিলেন আমার সঙ্গে ওদের ঝগড়া, ওখানে গাইব না ঠিক করেছি। কিন্তু আপনি নেজ যখন এসেছেন, আমি আপনার জন্যই গাইব।
হেমন্তর আন্তরিকতা মুগ্ধ লতা, তৈরি দাদা-বোনের সম্পর্ক
ফিল্মিস্তানে গিয়ে গান গাইতে আপত্তি ছিল বলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁর বাড়িতে এসে গান তোলার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিকতা মুগ্ধ করেছিল লতাকেও। সেই সূত্রে ধরেই তৈরি হল দাদা-বোনের সম্পর্ক। তা আবহমানকাল ধরে অটুট ছিল। হেমন্তর বাড়িতে গান তোলা হল, রেকর্ডিং হল, তারপর তা ইতিহাস। হেমন্ত-লতা জুটির পথ চলা শুরু হল সেই থেকে। সই সুরের ভেলা ভেসে চলেছে শেষ দিন পর্যন্ত।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বইয়ে গেলেন, লতাকে দিয়ে গাওয়ালেন
বাংলা গানের জগতেও তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই শেষ কথা। তিনিই সর্বেসর্বা। সেই সময়ই তিনি মুম্বই থেকে ডাক পেয়েছিলেন। আনন্দমঠ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য। পরিচালক হেমেন গুপ্তের খুব ইচ্ছা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেন তাঁর ওই ছবিতে সুর করেন। হেমেন গুপ্তের ডাকে সাড়া দিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বইয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা ছেড়ে যেতে একটুও মন চাইছিল না। তবু গেলেন। লতাকে দিয়ে গান করালেন।
হেমন্তর বাড়িতে লতা রিহার্সাল দিলেন তিনদিন
'আনন্দমঠ' ছবির গান 'বন্দেমাতরম'-এর সুর করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। লতাকে দিয়ে সেই গান গাওয়ানোর তোড়োজোড় শুরু হল। ফিল্মিস্তানের সঙ্গে ঝগড়া সত্ত্বেও লতা গাইলেন সেই গান, এমনকী পয়সাও নিলেন না, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে জানিয়ে দেন, শুধু আপনার জন্য গান গাইছি, পয়সার জন্য নয়। এ ব্যাপারে ফিল্মিস্তানের সঙ্গে কোনও কথা বলার দরকার নেই। তারপর শুরু হল রিহার্সাল। হেমন্তর বাড়িতে লতা রিহার্সাল দিলেন তিনদিন। যা তিনি সচরাচর করতেন না। গান টেক হচ্ছে, ভালো গাইছেন লতা। কিন্তু প্রাণের অভাব বোধ করছেন পরিচালক। লতা নিজেই নিজের গান যাচাই করে ভালোমন্দ রায় দিতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর গান রিজেক্ট করে দিচ্ছেন পরিচালক।
লতাকে কম করে ২০-২১টা টেক করতে হয়েছিল
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে তখন ভরসা দিলেন স্বয়ং লতাই। তিনি বললেন, দাদা আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার গান টেক করে তবে আমি যাব। যতক্ষণ না পরিচালকের পছন্দ হচ্ছে, ততক্ষণ আমি গান করে যাব। লতাকে কম করে ২০-২১টা টেক করতে হয়েছিল। সেই প্রথম রেকর্ড হল হেমন্ত-লতা জুটিতে। সেই যে পথ চলা শুরু হয়েছিল তা থামেনি সারাজীবন। হেমন্ত দাদার সঙ্গে লতার জুটি শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল।
হেমন্ত-লতার সৃষ্টিতে বহু কালজয়ী বাংলাগানও
বহু কালজয়ী গান তাঁরা উপহার দিয়েছেন। শুধুব হিন্দি জগতে নয়, বাংলাতেও লতা মঙ্গেশকরকে বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মণিহার, শঙ্খবেলা, অদ্বিতীয়, দীপ জ্বেলে যাই, মন নিয়ে'মতো বহু ছবিতে বাংলা গানে সুপার-ডুপার হিট হয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। লতাকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে'তুমি রবে নীরবে'র ডুয়েট সঙ্গীত জগতের এক অমরসৃষ্টি হয়ে রয়ে গিয়েছে।
সুরে সুরে বাংলার সঙ্গে সেতুবন্ধন হয়েছিল হয়েছিল লতার
বাংলার সঙ্গে তাঁর চিরকালের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সুরে সুরে বাংলার সঙ্গে সেতুবন্ধন হয়েছিল তাঁর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মন, রাহুল দেব বর্মন, বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে মাতিয়ে দিয়েছেন বাংলা সঙ্গীত জগৎ। তিনি ভালো বাংলা বলতে পারতেন না, কিন্তু সব বুঝতে পারতেন। বাংলা শেখার জন্য তিনি শিক্ষকও রেখেছিলেন। বাসু ভট্টাচার্য ছিলেন তাঁর বাংলা শিক্ষক।
বাংলা সঙ্গীত জগতে হেমন্ত-সন্ধ্যার মতো হেমন্ত-লতাও জুটি
তখন হিন্দি জগৎ হোক বা বাংলা সঙ্গীত জগৎ। বাঙালি সুরকারদের দাপাদাপি ছিল। সেইসূত্রেই তাঁরা পরিচয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। একসময় দুই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। লতার কছে কতটা আপন ছিলেন তাঁর হেমন্তদা সেটা বেশ কিছু ঘটনায় বারবার সামনে এসেছে। আনন্দমঠ থেকে শুরু করে বাংলা ফিল্মে লতার অন্তর্ভুক্তি, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানো নানা ঘটনা পরম্পরায় বাংলা সঙ্গীত জগতে হেমন্ত-সন্ধ্যার মতো হেমন্ত-লতাও জুটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
বলিউডে ইন্দ্রপতন, চিরদিনের মত থামলেন 'নাইটিঙ্গেল' দিশেহারা শিল্পী মহল
ছবি সৌজন্য:লতা মঙ্গেশকর /ফেসবুক পেজ