সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছাড়লে পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি-র পালে হাওয়া বইবে, বোঝালেন অমিত
তিনদিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন অমিত শাহ। বলা ভাল তিন দিনে ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন তিনি। বিজেপি-র পালে হাওয়াও লেগে গেল জোর।
কলকাতা, ২৮ এপ্রিল : তিনদিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন অমিত শাহ। বলা ভাল তিন দিনে ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন তিনি। বিজেপি-র পালে হাওয়াও লেগে গেল জোর। এই তিন দিনে তিনি বেশ কিছু দলীয় বৈঠক করেছেন। কর্মসূচি অনুযায়ী পাঁচটি করে বাড়ি ঘুরেছেন। ছোটখাটো জনসভা করেছেন। গেছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর খাস তালুক ভবানীপুরেও। কিন্তু কোথাও তিনি উগ্রতা প্রকাশ করেননি।
আর এটাই অ্যাডভান্টেজ দিয়ে গিয়েছে বিজেপি-কে। কোথাও সংখ্যালঘুদের টার্গেট করেননি। এটাও একটা মাস্টারস্ট্রোক অমিত শাহের। পাক্কা রাজনীতিকের মতো রাজ্যের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেছেন। জোর দিয়েছেন সংগঠনে। যাবার বেলায় সাফ বলে গেছেন- সারদা-নারদ নিয়ে ভাবনা আপনাদের নয়, সবার জন্য দলের দরজা খুলে দিন। সংগঠন বাড়ান।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই, অমিত শাহ তিন দিন ধরে যে শিক্ষা দিয়ে গেলেন, তা কি রপ্ত করতে পারলেন না রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বা অন্যান্যরা। দলের রাজ্য সভাপতির মুখে মাধমধ্যেই যে মাফিয়াসুলভ হুমকি শুনতে পাওয়া যায়, তা কিন্তু দলের পক্ষে শোভন নয়- তা বাংলার কালচারের সঙ্গে যায় না- এটা দিলীপ ঘোষের এবার বোঝা দরকার।
অমিত শাহ সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এসে নিজেকে বদলেছেন। গুজরাট হত্যাযজ্ঞের গেমমেকার বলে তাঁর নামের পাশে একটা কালো ছিটে রয়েই গিয়েছে। কিন্তু সর্বভারতীয় স্তরে এসে তিনি বুঝেছেন রাজ্যের সংকীর্ণ ধ্যানধারণা আর চলবে না। ক্ষেত্রটা এখন অনেক বিস্তৃত। ফলে রাজ্যের এই সফরে এসে রাজ্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন। পলিটিক্যালি কারেক্ট থেকেছেন। অযথা সংখ্যালঘু বিদ্বেষও ছড়াননি।
তাই বলা যায়, বিজেপি যদি সাম্প্রদায়িকতা ছাড়ে এ রাজ্যে ভালো কিছু করে দেখাতেই পারে। এমনকী তৃণমূলকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসতেও পারে তারা। অমিত শাহ বুঝেছেন ত্রিশূল-তরবারি নাচিয়ে উন্মাদনা ছড়ানো যায় ইভিএমে ম্যাজিক দেখানো যায় না। ভোট মেশিন সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
রাজ্যে শাসকদল বদলে সংখ্যালঘুরা ভেবেছিল এবার বোধহয় সুদিন আসবে। রাজভোগ না হোক ডালরুটি বা শাক ভাতের একটা হিল্লে হবে। মনে স্বস্তি আসবে। তৃণমূল যে পয়সার অপর পিঠ তা বুঝতে দেরি হয়নি অনেকেরই। তাই বীরভূম দিয়ে শুরু, সাম্প্রদায়িক দল জেনেও বিজেপির অন্ধ বিরোধিতা থেকে সরে এসেছেন অনেক সংখ্যালঘুই।
রাজ্যের ২৭ শতাংশ জনজাতি সংখ্যালঘু। শুধু তাদের নিয়ে স্বপ্ন সফল করা যাবে না। তাই অমিত শাহ এমন বার্তা দিয়ে গেলেন যে, সংখ্যালঘু ভোট একেবারে অচ্ছ্যুৎ রাখা যাবে না। সংখ্যালঘু বিদ্বেষ না ছড়িয়ে রাজনৈতিক মোকাবিলার পথই বেছে নিতে হবে তাঁদের। এখন দেখার দিলীপ ঘোষ, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়রা তা বোঝেন কি না? না বুঝলে বিপদ বিজেপিরই। ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন তাঁদের অধরাই থেকে যাবে।
গোহত্যা, ভারতমাতা কী জয়, বন্দেমাতরম, গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ করার দাবি, সূর্যপ্রণাম, কাশ্মীর, অনুপ্রবেশ, গোলাম আলির অনুষ্ঠান ইত্যাদি ইস্যুতে দেশ যখন উত্তপ্ত, তখন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ হুমকি দিয়েছেন-পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার, উচ্চতা ছ'ইঞ্চি কমিয়ে দেওয়ার, ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার, বন্দুক বার করার ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বুঝেছেন, তিনি যে উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখছেন সংখ্যালঘুদের পাশে সরিয়ে রেখে তা সম্ভব নয়। তাতে সংবিধানও লঙ্ঘিত হবে। তাই তিনি সংখ্যালঘু উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছেন। গো-রক্ষদের বিরুদ্ধে কামান দেগেছেন। নেতা-কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, বিনয়ী হতে হবে।
সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেস কোমর সোজা করতে পারছে না। বামেরা এতদিনেও সারা দেশে শক্তি বাড়াতে পারেনি। ফলে জাতীয় স্তরে একক শক্তিতে বা জোট গড়ে সামনের সারিতে আসতে পারবে এমন দল নেই। আঞ্চলিক দলগুলো বড় জোর কোনও বড় দলের জোট সঙ্গী হতে পারে। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল বা সর্বভারতীয় মোর্চা গড়ার ক্ষমতা রাখে না। তাই সামনে থাকে একমাত্র বিজেপি।
রাজ্যে বামশক্তিকে গত ৬ বছরে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে তৃণমূল। তবে তাঁদের দ্রাস করেছে নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, অত্যাচার, স্বেচ্ছাচার ইত্যাদি। ইতিমধ্যে তাঁরা মানুষের শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। মানুষ এই পরিস্থিতিতে বিজেপিকেই ত্রাতা ভাবছে। সাম্প্রদায়িক দল জেনেও বিজেপিকে ভরসা করতে শুরু করেছে।
এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। মমতার প্রতিশ্রুতি তা ছিল না। তার দল মানুষকে বিজেপির দিকে যেতে পরোক্ষে বাধ্য করছে। এটা বিজেপি বুঝেছে। তাই রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। সে স্বপ্ন তারা সফল করতে পারে, যদি সাম্প্রদায়িকতা ত্যাগ করে। অযথা অকারণে সংখ্যালঘু সমাজকে টার্গেট না করে। বিদ্বেষ না ছড়ায়।