কলম্বাসের দেশে ধরিত্রী, স্বপ্ন-ডানায় আবেশ মেলল আবেগ, বাঙালি বধূর কলমে এক অসামান্য ডায়েরি
ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতাম আইফেল টাওয়ার এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবো। তাই যেদিন আমার বিয়ে ঠিক হয় আমেরিকায় থাকা ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে সেদিন থেকেই স্বপ্নটা আরও বেশি করে দেখতে লেগেছিলাম।
ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতাম আইফেল টাওয়ার এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবো। তাই যেদিন আমার বিয়ে ঠিক হয় আমেরিকায় থাকা ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে সেদিন থেকেই স্বপ্নটা আরও বেশি করে দেখতে লেগেছিলাম।
যাই হোক, বিয়ের পর আমরা এলাম শার্লট এ, আমেরিকা পূর্ব দিকের একটি রাজ্য নর্থ ক্যারোলিনা-তে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। হেসে খেলে ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। ঠিক মাস পাঁচেক পর আমার স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্ক-এ দিলাম পাড়ি।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। এ কি দেশ রে বাবা! কোনো সাদা চামড়া নেই কেন? মনে হচ্ছে সবাই ভারতীয়। আমার অবাক মুখ দেখে বর বললো, এটাই নাকি এই শহরের বৈশিষ্ট। নানা ধরণের, রঙের লোক , সবাই ছুটছে , সবাই ব্যস্ত।
মেট্রো তে করে নামলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। সেখানে গিয়ে দেখি একটা উঁচু বিল্ডিং,যেটা দেখেই মনে পরে গেলো ৯/১১ ঘটনা। কী ভয়াবহ! এত্তো বড় ইমারত পুরো ছাই-এ ভষ্যিভূত হয়ে যেতে দেখেছিলাম টিভি-তে। আজ সেই ইমারত নতুন ভাবে, নতুন প্রযুক্তি তে গড়ে উঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইমারত তো নয়, যেন একটা ফিনিক্স পাখি। তার নিচে কত লোক। আর ঠিক সামনে ৯/১১ তে শহিদ হয়ে যাওয়া সকল শহিদের সমাধি। দেখেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
এরপর সেখান থেকে আবার একটা ট্রেন ধরে আমরা পৌঁছলাম নিউ জার্সি-তে, হাডসন নদীর এর ধারে। প্রায় এক দশক আগে এই হাডসন নদীতে একটা আস্ত প্লেন পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকা সেই ছবিটা আজও মনে গেঁথে রয়েছে। তখন আমি অনেকটাই ছোট। স্কুলের গণ্ডী তখনও পার করিনি। সেই হাডসন নদীর তিরে এসে মনটা নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। হাডসন নদীতে সেই প্লেন পড়ার ঘটনা পড়ে হলিউডে 'সালি' নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছিল। হাডসন নদীর তীর থেকে নিউ ইয়র্ক এর স্কাই-লাইন দেখে হোটেলে যাওয়ার কথা ভুলে গেছিলাম । চড়া রোদ-কে তোয়াক্কা না করে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমার স্বপ্নের শহর-কে। কি যে অপূর্ব দেখতে লাগছিলো বলে বোঝানো যাবে না।
কোনও রকমে হোটেলে পৌঁছে স্নান করে আমরা ছুটলাম ব্রুকলিন ব্রিজ। গিয়েই মনে হচ্ছে সব জায়গায় শাহরুখ খান দাঁড়িয়ে। এই তো সেই জায়গা যেখানে আমার প্রিয় মানুষটি সাদা জামা পরে 'কাল হো না হো'-র সেই বিখ্যাত গানে লিপ দিয়েছিল। হ্যাঁ, এই তো সেই ব্রিজ! আমি তো আনন্দে লাফাচ্ছি। শাহরুখ খান-কে বাদ দিয়েও কত ইতিহাস এই ব্রিজটার। ম্যানহাটান এর শ্রমিকরা যাতে অনায়াসে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতে পারে তাই এই ব্রিজটি তৈরী হয়েছিল। তারপর থেকে কত ইতিহাস , কতবার কত ইঞ্জিনিয়ার এর হাত বদল হয়ে তৈরী হয়েছে এই ২ কিলোমিটার লম্বা ব্রিজ।
এবার ফেরার পালা। রাতের ভুরিভোজ সেরে আমরা আবার জার্সি সিটি-তে ফিরলাম। এবার নেমেই আমি যা দেখলাম সেটা কোনোদিন ভোলার নয়। নিউ ইয়র্ক-কে নতুন ভাবে দেখলাম হাডসন নদীর এপার থেকে। আলোয় মোড়া সমস্ত টাওয়ার, কি অপরূপ আর মায়াবী! মন ভরে যায় সেই দৃশ্য দেখে।
দ্বিতীয় দিন আমাদের গন্তব্য ছিল ওয়াল স্ট্রিট। আর ফেরি-তে করে স্টাটেন আইল্যান্ড। ওয়াল স্ট্রিট নেমে বড় বাড়িগুলো দেখে মাথায় হাত। এতো উঁচু তে মানুষ কাজ করে ? সারি বেঁধে সমস্ত অফিস বিল্ডিং দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে হাঁটা পথে গেলাম নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। একটা বিশাল চওড়া বিল্ডিং যার ওপরে দৈত্যাকার এর আমেরিকার পতাকা। সমস্ত স্টক এর মূল্যায়ন পাশে থাকা একটা স্ক্রিন এ ফ্ল্যাশ হচ্ছে।
আমরা হেঁটে পৌঁছলাম ফেরির কাছে। জাহাজে উঠলাম। আর হাডসন-এর ওপর থেকে চলা শুরু করলো আমাদের জাহাজ-টি। জলের বুদ্বুদ দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ পড়লো মাঝ নদীতে। ওইতো লিবার্টি লেডি!! দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে টর্চ নিয়ে , মাথায় কাঁটা দেওয়া মুকুট। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। খুব কাছ থেকে ঘুরিয়ে আমাদের স্টাটেন আইল্যান্ড নামিয়ে দিলো জাহাজ। সেখান থেকে আবার নতুন জাহাজ নিয়ে ফিরতে হবে নিউ ইয়র্ক। ফেরার পথে আবার দেখলাম আমার স্বপ্নের স্ট্যাচু অফ লিবার্টি-কে। কাছ থেকে দেখার জন্য অপেক্ষা নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।
(ধরিত্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের বেড়া ওঠা পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর শহরে। পড়াশোনার জন্য পরে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। ২০১৮ জানুয়ারিতে আমেরিকা প্রবাসী অর্চিস্মান ভট্টাচার্য-র সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়েন ধরিত্রী। ঘুরতে এবং লিখতে পছন্দ করেন ধরিত্রী। তাঁর আমেরিকা প্রবাসের কিছু কাহিনি এখানে তুলে ধরেছেন তিনি।)