অপার রহস্যে মোড়া সুন্দরবনে সুন্দরী বঙ্গের সেরা আকর্ষণ, আজ প্রথম কিস্তি
একদিকে গঙ্গা, অন্যদিকে মেঘনা তো অপর দিকে ব্রহ্মপুত্র। তিন নদী ও নদের অববাহিকায় তৈরি বদ্বীপ অঞ্চল বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টা। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্য়ানগ্রোভ অরণ্য এই সুন্দরবন। নিবিড় রহস্য যেখানে ভয়ঙ্করের চেয়েও সুন্দর। সেই টানে বেরিয়ে পড়া বাঙালি মনের সহযাত প্রবৃত্তি। তেমনই আবিষ্ট হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম বন্ধুরা। সুন্দরী জঙ্গলের দেশ ছিল গন্তব্য।

উঠলো বাই তো বনে যাই
বারো মাসে তেরো পার্বনের বাংলায় কর্মবিরতি এখন বেশ সহজলভ্য। সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে কি থাকা যায়! গত শীতে পাওয়া বেশ কিছু দিনের ছুটিকে কার্যত লুফে নিল দল। কালবিলম্ব না করে বানিয়েও ফেলা হল ভ্রমণের পরিকল্পনা। গোল টেবিলে চায়ের তুফান ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পর এক হল দশ মাথা। ডেস্টিনেশন সুন্দরবন। যাতায়াতে নেই আহামরি কষ্ট। শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে ক্যানিং-এ নেমে, সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ি, ট্যাক্সি কিংবা বাসে করে পৌঁছে যাওয়া গদখালি, সুন্দরবনের এন্ট্রি পয়েন্ট। সড়ক পথেও কলকাতা থেকে সরাসরি গদখালি ও ক্যানিং যাওয়ার বাস পাওয়া যায় হামেশা।

নামকরণ
বাংলায় সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা বন অথবা বনভূমি। বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টাকে সুন্দরী গাছের স্বর্গরাজ্য বলা হয়। সেই থেকে এর নামও নাকি সুন্দরবন। জলপথে সেই স্থানে পৌঁছে সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় অবশিষ্ট থাকে না।

ভৌগলিক গঠন
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। ওপার বাংলার খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলা সুন্দরবনের অন্তর্গত। এপার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দরীর জঙ্গল। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ বা ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার অংশে নদী-নালা, খাঁড়ি, বিলের একাধিপত্য। বাকিটা স্থলভাগ। বনের ঘনত্ব ও ব্যাপকতা এতটাই যে, ১৯৯২ সালে ইরানের রামসার কনভেনশনে সুন্দরবনকে বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্বের বৃহৎ ডেল্টাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দেয় ইউনেস্কো।

ইতিহাস
কথিত আছে, মুঘল আমলে এক স্থানীয় রাজা গোটা বনের ইজারা নেন। ১৭৫৭ সালে মুঘলদের হাত থেকে সুন্দরবনের দখল কার্যত চলে যায় ইংরেজদের কাছে। সুবিশাল বনের মানচিত্র তৈরি করে ফেলা হয় রাতারাতি। ১৮২৮ সালে খাতায়-কলমে স্থানের স্বত্বাধিকার পায় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮৬০ সালে সুন্দরবনকে সাংগঠনিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। ১৮৭৯-তে বনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন বাংলা প্রদেশের নবনির্মিত বন বিভাগকে।
বলা হয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমান অবস্থার নাকি দ্বিগুন ছিল। জনসংখ্যার চাপ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বনের আয়তন সঙ্কুচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। সেসব জানতে জানতেই জলপথে পৌঁছে যাওয়া বনভূমিতে।

উদ্ভিদ ও প্রাণীর মেলবন্ধন
উদ্ভিদ ও প্রাণীর অপরূপ মেলবন্ধনে নিজ রূপে ভাস্বর সুন্দরবন। যার প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া গাছের টান। সবমিলিয়ে সুন্দরবনে ২৪৫ শ্রেণি ও ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে বলে প্রাচীন এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়।
একাধারে বন্যপ্রাণও সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ বলা চলে। পৃথিবী বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এই বনের রাজা। রয়েছে হরিণ, গণ্ডার, মহিষ, কুমীর, কচ্ছপ, গোসাপ, অজগর ও নানা প্রজাতির পাখি। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে সুন্দরবনে ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮টি উভচর প্রজাতির প্রাণীর বাস। যার মূখ্য আকর্ষণ অবশ্যই সেই ডোরাকাটা দক্ষিণরায়।

চোরা শিকারিদের দাপটেও বেঁচে দক্ষিণরায়
সুন্দরবনে বেড়েই চলেছে চোরা শিকারিদের দাপট। বন বিভাগ একাধিক কড়া পদক্ষেপ নিলেও নির্বিচারে বাঘ নিধন চলছে অবিরাম। ফল স্বরূপ দুই বাংলা জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনে গত ২০ কুড়ি বছরে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে বলে আশঙ্কা। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় গত ১০ বছরে জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেড়েছে বলে এক পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়েছে। এখন সেখানে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৫০০-ক কিছুটা বেশি বলে জানানো হয়েছে।

এবার ভেসে চলা
সেসব তথ্য জেনে মাতলা নদীতে ভেসে চলা দো-বাঁকি, সজনেখালি, হ্যালিডে দ্বীপ, লোথিয়ান দ্বীপ, নেতিধোপানি, কলসদ্বীপের দিকে। তার আগে কিছুটা জিরিয়ে নিল দল।
(প্রথম কিস্তি)