বরফে মোড়া সোনমার্গ থেকে গুলমার্গ, এক মায়াজালের নাম কাশ্মীর
ভূস্বর্গ কাশ্মীর পর্যটকদের স্বপ্নের নিকেতন। পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণি উপত্যকাকে সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
ভূস্বর্গ কাশ্মীর পর্যটকদের স্বপ্নের নিকেতন। পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণি উপত্যকাকে সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। চারপাশে তুষারধবল শৃঙ্গরাজি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এক অনন্য রূপ তৈরি করেছে। যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তবু চেষ্টা তো করাই যেতে পারে। তাতে স্বর্গীয় আনন্দ না থাকলেও ভালোলাগা তো থাকতেই পারে!
সোনমার্গ
ডাল লেকের শোভা দেখে মুগ্ধ চিত্তে যখন সবাই সুখস্মৃতি আওড়ে চলেছে, ঠিক তখনই কেনারাম দার (ট্যুর মাস্টার) ডেপুটি সুশোভন ঘরে এসে জানালেন যে দ্বিতীয় দিনের ডেস্টিনেশন, সোনায় মোড়া সোনমার্গ।
ভোরে উঠে চটজলদি তৈরি হয়ে ব্রেকফার্স্ট সেরে নিলাম। ট্যুর মাস্টারের কথামতো সকাল আটটার মধ্যে গাড়িতে গিয়ে বসলাম সবাই। ডাল লেককে বাঁ-দিকে রেখে আমাদের রথ দ্রুতবেগে সোনমার্গের দিকে এগিয়ে চলল। বাইরের তাপমাত্রা আগের থেকে অনেকটাই কম মনে হল। নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে মাফলারটা কষে গলায় জড়িয়ে নিলাম। তুলে দেওয়া হল গাড়ির জানলার কাচও।
শ্রীনগর থেকে উত্তর-পূর্বে ৮০ কিমি দূরে, ৮৭৫০ ফুট উঁচুতে সোনমার্গের অবস্থান বলে জানালেন কেনারাম দা। ঝিলাম নদীর ধার ঘেঁষে আকাবাঁকা পথ সোজা চলে গিয়েছে সেদিকে, যেদিকে চলেছি আমরা। একদিকে নদী, অন্যদিকে পাইন ফারের বনাঞ্চল- সবমিলিয়ে যাকে বলে নয়নাভিরাম শোভা। এই পথই জোজিলা পাস পেরিয়ে লাদাখে পৌঁছচ্ছে বলে জানালেন গাড়ির চালক প্রীতম সিং। এও মনে করালেন যে সোনমার্গের আবহাওয়ায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়। তবু সোনালী ঘাসে ঢাকা সেই উপত্যকা। তাই সোনমার্গকে সোনার বাগিচা হিসেবেও চেনেন অনেকে।
তখনও গন্তব্যের কাছে পৌঁছয়নি আমাদের গাড়ি। তার আগে আকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দুধারে উঁচু বরফের চাঁই। সোনালী আলোয় খিল খিল করছে তার রূপ। উল্লাস ধরে রাখা মুশিকল। কেনারাম দা জানালেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটে উপত্যকা জুড়ে। তার রূপও অনন্য। ঘণ্টা দেড়েক বরফের বুকে গড়াগড়ি দিয়ে অবশেষে পেটের টানে সদলবলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। সেখান থেকেই দেখা যায় স্থানীয় মানুষের হাতে বানানো গাছের বাকলের স্লেজগাড়িতে হু হু করে ওপর থেকে নিচে নামছে পর্যটকরা। অদূরে স্কি-র আনন্দ উপভোগ করছেন কেউ কেউ। সেসব দৃশ্য চোখেমুখে মেখে ফেরার পথ ধরল প্রীতম সিং-র রথ। পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নামার সময় মনে প্রশ্ন জাগে, এমন সৌন্দর্য্যের কোলে বসেও কেন উত্তপ্ত হয় উপত্যকা। হানাহানির চৌকাঠ থেকে কবে মুক্তি পাবে ভূস্বর্গ!
শ্রীনগর
পরদিন
সকালে
ট্যুর
মাস্টার
জানালেন
যে
সেদিন
শুধুই
লোকাল
সাইট
সিয়িং।
সেই
মতো
জল
খাবারের
পাট
চুকিয়ে
সদলবলে
বেরিয়ে
পড়লাম।
প্রথমেই
পৌঁছলাম
ঐতিহাসিক
শঙ্করাচার্যের
মন্দিরে।
ডাল
লেকের
কাছে
নেহেরু
পার্কের
একেবারে
শেষ
মাথায়
পাহাড়
কেটে
রাস্তা
উঠে
গেছে
ওপরের
দিকে।
কথিত
আছে,
সম্রাট
অশোকের
পুত্র
ঝালুকা
খ্রিষ্টপূর্ব
২০০
অব্দে
শ্রীনগর
থেকে
৩০০
মিটার
উঁচুতে
একটি
শিব
মন্দির
গড়েন।
জ্ঞান
তপস্যী
শঙ্কারচার্য
ভারত
ভ্রমণকালে
এই
পাহাড়ে
বসে
তপস্যা
করেন
বলে
শোনা
যায়।
তাই
তাঁর
নামে
ওই
পাহাড়ের
নামকরণ।
২৪০টি
সিঁড়ি
ভেঙে
উপরে
উঠে
মুগ্ধ
হলাম
ওপর
থেকে
কাশ্মীর
উপত্যকা
দেখে।
একদিকে
ঝিলাম,
অন্যদিকে
মোহময়ী
ডাল
লেক
শ্রীনগরকে
জড়িয়ে
রেখেছে।
যেখানে
আলো-আঁধারির
খেলা
চলেছে
আপন
খেয়ালে।
শ্রীনগর থেকে ৮.৮ কিমি দূরে পাহাড়ের পাদদেশে মোঘলদের হাতে তৈরি ছোট বাগানের নাম চশমাশাহি। মোঘল সম্রাট শাহজাহান সপ্তদশ শতাব্দীতে ওই বাগান তৈরি করলেও, তার নির্মাণকাজ জাহাঙ্গীরের আমলে শুরু হয় বলে শোনা যায়। এখানকার পবিত্র প্রস্রবণের জল পান করে রোগ-ব্যাধি নিরাময় হয় বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। অন্যদের দেখাদেখি দলের কয়েকজন বেশ কয়েক বোতল জল ভরে নিলেন।
চশমাশাহী
থেকে
৩২
কিমি
দূরে
পাহাড়
কেটে
তৈরি
করা
হয়েছে
আরও
একটি
প্রমোদ
কানন।
যার
নাম
নিশাতবাগ।
১০
ধাপ
ওপরে
অবস্থিত
এই
বাগান
শ্রীনগরের
অন্যতম
প্রমোদ
উদ্যান।
সেখান
থেকে
২.৩
কিমি
দূরে
শালিমার
গার্ডেনের
আনাচে-কানাচে
লুকিয়ে
রয়েছে
মোঘল
সম্রাট
জাহাঙ্গীর
ও
নূরজাহানের
প্রেমের
গাথা।
আলাদা
করে
টিউলিপ
গার্ডেনের
বর্ণনা
না
দিলে
অনেকটাই
বাকি
থেকে
যায়।
পাহাড়ের
কোলে
লাল,
হলুদ,
সাদা,
সবুজ,
নীল,
গোলাপী,
বেগুনি
টিউলিপ
ফুলে
সাজানো
কার্পেটে
একবার
পা
দিলে
আর
অন্য
কোথাও
যেতে
মন
চায়
না।
ওই
দূরে
পাহাড়ের
কোলে
মেঘের
নিদ্রা
ভঙ্গ
করার
সাহস
দেখাবে
কে!
ডাল লেকের পশ্চিম তীরে অবস্থিত হজরতবাল মসজিদ ভূস্বর্গের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবেই চিহ্নিত। সেখানেই এক কাঁচের আধারে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের কেশ রাখা আছে বলে স্থানীয়দের দাবি। ব্যাস, সেদিনের মতো অক্ষি যুগলের ছুটি। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে পড়তে হবে বরফের দেশ গুলমার্গের দিকে।
গুলমার্গ
আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় সেদিন আরও সকালে প্রীতম সিং-র গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। হিমেল হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে শরীরে। শ্রীনগর থেকে বারামুলার পথে যেতে মাইল দশেক এগোনোর পর বাঁ-হাতে গিয়েছে গুলমার্গের রাস্তা।
প্রায় ৮৫০০ ফুট ওপরে পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণির উত্তরদিকের ঢালে দুর্গম গুলমার্গ ও খিলানমার্গের অবস্থান। লোকমুখে প্রচলিত, ভয়ঙ্কর সুন্দর এই উপত্যকার আগের নাম ছিল গৌরীমার্গ। মহাদেব জায়া গৌরীর নাম অনুযায়ী এই নামকরণ বলে কাশ্মীরিদের বিশ্বাস। সুলতান ইউসুফ শাহ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে এই এলাকার নাম পরিবর্তন করেন বলে শোনা যায়। গুলমার্গের অর্থ ফুলের উপত্যকা। বরফ গলে গেলে উপত্যকা জুড়ে রঙিন বনফুলের সন্মেলন বসে। মনে হয় স্বর্গের পারিজাত মর্ত্যে নেমে এসেছে। এমনকী ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে গুলমার্গে রঙ ও রপের পরির্তন হয় বলেও স্থানীয়দের দাবি। যদিও আমরা সাক্ষী থাকলাম দিগন্ত জোড়া বরফে ঢাকা উপত্যকার। শুধু মাটি হলে ঠিক ছিল। আকাশ থেকেও ঝিরিঝিরি চিনির দানার মতো বরফ কনা আমাদের সারা শরীর জুড়ে খেলা করতে শুরু করল। দাঁতে দাঁতে চেপে সেই রূপে ডুব দিলাম আমরাও।
গুলমার্গ থেকে খিলানমার্গে যাওয়ার রোপওয়ের টিকিট কাটা ছিল আগে থেকেই। সকালের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হিমেল হাওয়া যেন শাপে বর হল। 'কেবল কার' থেকেই দেখলাম যে বরফের গুড়ো নিচের পাইন জঙ্গলকে সাদা পেইন্ট করেছে। যতদুর চোখ যায়, দেখা যায় সবুজ ও সাদার কী নিবিড় প্রেম। আমার স্বপ্নে দেখা পাহাড়, নদী, পাইন, দেওদার ও ফারের জঙ্গল আর তুলোর মতো মতো বরফ কুঁচি আমার হৃদয়-সত্ত্বায় জড়িয়ে গেল। এই যদি স্বর্গ হয়, তবে কেন এত অস্থিরতা। 'মৃত্যু উপত্যকা' এর পরিচয় হতে পারে না। রাস্তায় এক জায়গায় লাঞ্চ সেরে বিকেলে ফিরে এলাম শ্রীনগরের হোটেলে।
(দ্বিতীয় কিস্তি)