তৃণমূল কেন ত্রিপুরাকেই সর্বাগ্রে বেছে নিল, মিশন ২৩-এ যে লক্ষ্যে ঘূঁটি সাজাচ্ছেন অভিষেকরা
তৃণমূল কেন ত্রিপুরাকেই সর্বাগ্রে বেছে নিল, মিশন ২৩-এ যে লক্ষ্যে ঘূঁটি সাজাচ্ছেন অভিষেকরা
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ফুল বেঞ্চকে নাকানিচোবানি খাইয়ে হারানোর পর তৃণমূল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভিনরাজ্যে সংগঠন বিস্তারে নেমেছছে। প্রথম রাজ্য হিসেবে মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা বেছে নিয়েছেন ত্রিপুরাকে। কিন্ত কেন ত্রিপুরাকেই তাঁরা বেছে নিলেন, কেন অন্য কোনও রাজ্য নয়, তার পিছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ।
ভিনরাজ্যে সংগঠন বিস্তার এবং আধিপত্য কায়েম
২০২১-এ বাংলার ভোট আদতে রূপ নেয় মোদী-মমতার দ্বৈরথে। সেই কুরুক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে যায় বাংলার মাটিতে তৃণমূলের আধিপত্যে থাবা বসানো সহজ কাজ নয়। বাংলা তৃণমূলের গড়। সই আত্মবিশ্বাস নিয়েই ত্রিপুরাকে সর্বাগ্রে বেছে নেওয়া হয়েছে ভিনরাজ্যে সংগঠন বিস্তার এবং আধিপত্য কায়েমের জন্য।
ত্রিপুরাকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ যা
তৃণমূলকে সর্বভারতীয় তকমা ধরে রাখতে বাংলার বাইরে কোনও রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে হবে। সেই রাজ্যের শাসক হতে না পারলেও প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে হবে। সেই লক্ষ্যপূরণে ত্রিপুরাই সহজ ক্ষেত্র হতে পারে তৃণমূলের কাছে। ত্রিপুরাকে বেছে নেওয়ার একটা প্রধান কারণ হল, সেখানকার ৬৪ শতাংশই বাংলাভাষী।
বিজেপি আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে রয়েছে ত্রিপুরায়
তৃণমূল একটা বাঙালিপ্রধান দল। সেই বাঙালি প্রধান দলের সর্বভারতীয় তকমা পেতে ত্রিপুরাকে বেছে নেওয়াই স্বাভাবিক। ত্রিপুরায় যেমন বাংলাভাষী মানুষই বেশি, তেমন ত্রিপুরায় সবথেকে বেশি টলমল অবস্থা বিজেপির সংগঠনে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে ঘিরে কোন্দল বিজেপির অন্দরে। বিজেপি আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে রয়েছে ত্রিপুরায়। ফলে ত্রিপুরায় ঘাঁটি গাড়া সহজ হবে অনেক। এটা অবশ্যই দ্বিতীয় কারণ তৃণমূলের ত্রিপুরায় পা রাখার।
বিজেপি ত্রিপুরার বাংলাভাষী মানুষের মনে নেই
আর তৃতীয় কারণ, ত্রিপুরায় আরএসএস বেশ কয়েক বছর ধরে সক্রিয় থাকলেও এখন আদতে ভিনরাজ্যের নেতাদের অঙ্গুলিহেলনেই চলে। বিজেপি ত্রিপুরার বাংলাভাষী মানুষের মনে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। ত্রিপুরায় তাই বিজেপি সরকারের প্রতি এই চার বছরেই মানুষ তিতিবিরক্ত। ত্রিপুরা পরিবর্তন চেয়েছিল। বিজেপির হাত ধরে সেই পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু ত্রিপুরার মানুষ বুঝতে পেরেছে তাঁদের বিকল্প চয়নে ভুল ছিল।
বাংলার সফল প্রকল্পগুলি দেখিয়ে জায়গা করছে তৃণমূল
কেননা ত্রিপুরায় প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি সরকার। আর এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল চাইছে ত্রিপুরাবাসীর মনে বাংলার সফল প্রকল্পগুলি দেখিয়ে পাকাপাকি জায়গা করে নিতে। সে কারণেই ত্রিপুরাকে সর্বাগ্রে বেছে নিয়ে একেবারে কোমর বেঁধে নেমেছে তৃণমূল। কিন্তু ত্রিপুরার পথও একেবারে কণ্টকমুক্ত নয় তৃণমূলের কাছে।
তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দল হিসেবে উঠে এসেছে তৃণমূল
ত্রিপুরায় পা দেওয়ার পর থেকেই পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তৃণমূলকে। মামলা আর হামলা দুই-ই সঙ্গী করেত চলতে হচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে। তা নিয়েই অবশ্য ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক পুরনির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে দ্বিতীয় দল হিসেবে উঠে এসেছে তৃণমূল। তিন মাসের মধ্যে ১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া মুখের কথা নয়, এটা মানতেই হবে।
বিজেপির আড়াআড়ি বিভাজন ঘটলে সম্ভাবনা বাড়বে
কিন্তু সমস্যা হল- এখনও পর্যন্ত বিজেপিক ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে পারেনি তৃণমূল। অন্তত ত্রিপুরার পুরভোট সেই বার্তাই দিচ্ছে। বিরোধীদের ভোট ভাগাভাগিতে তৃণমূল দ্বিতীয় হয়েছে। এখন আর হাতে সময় সাকুল্যে ১ বছর। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ত্রিপুরায় বিজেপিকে টপকে শাসকের আসনে বসা এখনও পর্যন্ত দুরুহ বলেই মনে হচ্ছে। তবে এর মধ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ যদি পরিবর্তন হয়, যদি বিজেপির আড়াআড়ি বিভাজন ঘটে, তখন একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
বিজেপি যদি মুখ্যমন্ত্রী মুখ পরিবর্তন করে, তখন
ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া চলছে। বিজেপির বিপ্লব দেব সরকারের প্রতি তিতিবিরক্ত মানুষ। কিন্তু ত্রিপুরাবাসী কি বিজেপি দলকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন বিজেপি যদি মুখ্যমন্ত্রী মুখ পরিবর্তন করে, তখন কি ফের বিজেপির পালে হাওয়া বইবে না, তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। কেননা ত্রিপুরার পুরভোটে বিজেপির সমর্থনে ভাটা পড়েনি। যদিও বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, ত্রিপুরার পুরভোট হয়েছে সন্ত্রাসের আবহে। ভোট হয়নি, ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে।
বিজেপিকে হারাতে গেলে ভোট সমীকরণ একটা ব্যাপার
তাও যদি মেনে নেওয়া যায়, ত্রিপুরায় বিজেপিকে হারাতে গেলে ভোট সমীকরণ একটা ব্যাপার। বিরোধীদের এই ছত্রখান অবস্থায় বিজেপিকে হারানো কঠিন। তৃণমূল কতটা ভোট-মেরুকরণ করতে পারে, বিরোধীদের কতটা ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তার উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যৎ। অন্যথায় তৃণমূলকে ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরতে হবে। কেননা সিপিএম যেমন তাদের মতো করে বিরোধিতা শুরু করেছে, কংগ্রেসও সংগঠন বাঁচাতে মরিয়া। এই অবস্থায় শুধু টিপ্রার সঙ্গে সমঝোতায় রাস্তায় হেঁটে কোনও ফায়দা হবে কি না, তা বলবে ভবিষ্যৎ।