যেন সাপলুডোর ছক, অদ্ভুত ভাবে জীবন কেটেছে রাষ্ট্রগুরুর
যেন সাপলুডোর ছক, অদ্ভুত ভাবে জীবন কেটেছে রাষ্ট্রগুরুর
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত জীবনটা যেন এক সাপলুডোর ছক। জন্ম ১৮৪৮ সালের ১০ই নভেম্বর, কলকাতায়। বাবা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তৎকালীন সময়ের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক, সমাজসেবী এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি থেকে পাশ করে ইংল্যান্ডে যান, আইসিএস হয়ে ফিরে ১৮৭১ সালে চাকরিতে প্রবেশ করেন। কিন্ত চাকরিতে হয়তো "যথাযথ" যোগ্যতার প্রমাণ দিতে না পারার কারণবশত বরখাস্ত হন।
জীবন ঘুরে যায় এর পরে। বেছে নেন শিক্ষকতা।শিক্ষকতা করেন মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন,ফ্রী চার্চ ইনস্টিটিউশন,রিপন কলেজে(পরে যার নামকরণ হবে ওনার নামানুসারে)।ঝাঁপিয়ে পরেন স্বাধীনতার কাজে।আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে সৃষ্টি করেন "ভারতসভা"-র যা পরবর্তীতে মিশে গিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের সাথে।হয়েছিলেন দুবার কংগ্রেস সভাপতি-১৮৯৫ এবং ১৯০২ সালে।বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। রাষ্ট্রগুরু উপাধি পান জনগণের সম্মানে।বাগ্মিতার জন্য সুবিখ্যাত।ওনার হাত ধরেই স্বাধীনতার যুদ্ধে এসেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং সরোজিনী নাইডু।
এই অবধি সাপলুডোর উত্থান। এরপরেই অদ্ভুত পতন। ১৯০৬ সালে কংগ্রেস ত্যাগ। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা।ইংরেজদের বিভিন্ন বিলের সমর্থন। উপহারস্বরূপ নাইট উপাধি লাভ এবং গ্রহণ। ক্রমশ তৎকালীন এই "বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবি" জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেন।চুড়ান্ত রূপ,১৯২৩ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে পরাজয়। এরপরেই চলে যান রাজনৈতিক সন্ন্যাসে। ১৯২৫ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ব্যারাকপুরের বাড়িতে ঘটে জীবনাবসান।
এছাড়াও, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ভারতীয় বিধানসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৮৭৬-১৮৯৯ সাল পর্যন্ত একাধারে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনেরও সদস্য হিসেবে ছিলেন। তার সুদক্ষ ও সুচারু নেতৃত্বের ফলে ভারতীয় সংঘ অল্প সময়েই পরিস্ফুটিত হয়। ১৮৮৩ সাল থেকে ভারতের সকল এলাকা থেকে আগত প্রতিনিধিদের নিয়ে নিয়মিতভাবে বার্ষিক সভা পরিচালনা করতেন তিনি। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা পায় এবং এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্যও ভারতীয় সংঘের সাথে মিল থাকায় ১৮৮৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের ২য় অধিবেশনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতীয় সংঘকে কংগ্রেসের সাথে একীভূত করেন। তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেসকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে দুইবার - ১৮৯৫ এবং ১৯০৭ সালে এর সভাপতিত্ব করেন।
১৯০৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং স্বদেশী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। অধিকন্তু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে তিনি মতানৈক্যজনিত কারণে ১৯১৮ সালে কংগ্রেস থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর তিনি মধ্যপন্থী হিসেবে হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষকে একীকরণের জন্য উদ্যোগী হন।
১৯২১ সালে তিনি নাইট উপাধি লাভ করেন এবং বাংলায় তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দেশের সেবায় মনোনিবেশ করেন। শিক্ষক হিসেবে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ছাত্রদেরকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত তথা উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। একই সাথে তিনি ভারতীয়দের একতাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। ঊনবিংশ শতকে রাজা রামমোহন রায়ের নির্দেশিত সমাজ-ধর্ম বিষয়ক পুণর্জাগরণের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন।