তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক নির্বাচন মিটতেই, একুশে দল বদলে চমক দিলেন যাঁরা
তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক নির্বাচন মিটতেই, একুশে দল বদলে চমক দিলেন যাঁরা
একুশের নির্বাচন আদতে দলবদলের নির্বাচন বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই নির্বাচনের আগে তৃণমূলে ভাঙন ধরিয়ে বিজেপি পরিবর্তনের জোয়ার আনতে চেয়েছিলেন। সেই পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসতে তৃণমূল থেকে দফায় দফায় নেতা-কর্মীরা বিজেপিতে গিয়েছেন। কিন্তু একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফের উল্টো স্রোতে ফিরতে হয়েছে পুরনো দলে। অনেকে রয়ে গিয়েছেন নতুন দলেই। বাংলায় তৈরি হয়েছে নয়া রাজনৈতিক সমীকরণ। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েই গিয়েছেন, বিরোধী দলনেতা হিসেবে উঠে এসেছেন তাঁরই একসময়ের ডানহাত শুভেন্দু অধিকারী।
শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়তেই বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক
একুশের দলবদলের কথা বলতে হলে প্রথমেই চলে আসবে ওই শুভেন্দু অধিকারীর নাম। তিনি ২০২০-র ডিসেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করলেও, তাঁর যোগদানের লক্ষ্য ছিল ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন। সেইমতো তিনি তৃণমূলে তাঁর ২০ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে তিনি অনুগামী সহযোগে বিজেপি শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন অমিত শাহের হাত থেকে পতাকা নিয়েছিলেন মেদিনীপুরের মঞ্চে, যেখানে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন তৃণমূলের প্রায় শতাধিক নেতা-নেত্রী। তৃণমূলকে ভেঙে তখন বাংলার ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে মশগুল বিজেপি।
শুভেন্দুর পথ ধরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আগমন রাজীবেরও
শুভেন্দু পথ তৈরি করেছিলেন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়ার। সেই পথ ধরে শুভেন্দু অধিকারীর পর গেরুয়া শিবির মুখী হয়েছিলেন তাবড় তাবড় নেতী-নেত্রীরা। সেই দলে ছিলেন তৃণমূলের আর এক তরুণ-তুর্কি নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দুর মতো তাঁকেও গুরুত্ব দিয়ে বিজেপিতে যোগদান করিয়েছিলেন অমিত শাহরা। চাটার্ড ফ্লাইটে করে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁকে যোগদান করানো হয়েছিল। তারপর হাওড়ার ডুমুরজলার মঞ্চে তিনি বিজেপি নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
শুভেন্দু-রাজীবদের হাত ধরে হেভিওয়েট যাঁদের আগমন পদ্মশিবিরে
শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে সেদিন যেমন তৃণমূলের সাংসদ সুনীল মণ্ডল থেকে শুরু করে ৯ জন বিধায়ক-সহ শতাধিক পদাধিকারী যোগদান করেছিলেন তৃণমূলে, তেমনই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও যোগদান করেছিলেন বিধায়ক ও প্রাক্তন মেয়ররা। সেই তালিকায় ছিলেন প্রবীর ঘোষাম, বৈশালী ডালমিয়া থেকে শুরু করে হাওড়া পুরসভরা প্রাক্তন মেয়র রথীন চক্রবর্তী প্রমুখ। ফলে দলবদলের জোয়ারে তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতারা বিজেপির দিকে চলে গিয়েছিলেন। সই আঙ্গিকে হয়েছিল ভোট।
বিজেপি ফুলেফেঁপে উঠেছিল শুভেন্দু-রাজীবদের দলবদলের পরেই
শুভেন্দু-রাজীবদের মতো প্রথম সারির নেতারা আর কেউ না গেলেও দ্বিতীয় সারির অনেকে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন একুশের নির্বাচনের আগে। সেই তালিকায় ছিলেন সোনালি গুহ, সরলা মুর্মু, অমল আচার্য, দীপেন্দু বিশ্বাস, অরিন্দম ভট্টাচার্যের মতো অনেক নেতা। ফলে বিজেপি ফুলেফেঁপে উঠেছিল শুভেন্দু-রাজীবদের দলবদলের পরেই। তার আগে তো তৃণমূলের প্রাক্তন সেকেন্ড ইন কম্যান্ড মুকুল রায়-সহ বহু নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
মুকুল রায়ের হাত ধরে তৃণমূলে আঙন লেগেছিল আগেই
একুশের আগে বিজেপিতে যোগদানকারীদের মধ্যে সবথেকে বড় নাম ছিল মুকুল রায়। মুকুল রায়ের হাত ধরে তৃণমূল নিচতুলায় ফোঁপরা হতে শুরু করে। সেইসঙ্গে মুকুল রায়ের অনুগামীরা একে একে যোগ দেন বিজেপিতে। সেই তালিকায় ছিলেন সব্যসাচী দত্ত, সৌমিত্র খান, অনুপম হাজরা, অর্জুন সিং, বিশ্বজিৎ দাস, দুলাল বরদের মতো অনেক নেতা। যাঁরা অনেকেই সাংসদ হয়েছেন, অনেকেই বিধায়ক হয়েছেন।
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে একুশেই সক্রিয় হন শোভন
শুধু এঁরাই নন, হেভিওয়েটদের মধ্যে আরও একটি নাম করতে হবে যিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি হলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তিনি যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। সেটা ২০২১-এর অনেক আগেই। কিন্তু বিজেপিতে তিনি প্রথম সক্রিয় হন ২০২১-এ ভোটের ঠিক আগেই। ফলে তৃণমূলের একটা বড় অংশকে নিয়ে বিজেপি এবার পরিবর্তনের যুদ্ধে নেমেছিল।
ভোট ফুরোতেই উল্টো যাত্রা, মুকুলের কামব্যাক তৃণমূলে
কিন্তু তৃণমূলকে ভেঙে তছনছ করে দিলেও বিধানসভা ভোটে চূড়ান্ত ধাক্কা খায় বিজেপি। ভোট ফুরোতেই উল্টো যাত্রা শুরু হয় দলবদলুদের। এক এক করে দলবদলু অনেকেই ফিরতে শুরু করেন। আর এই ফেরার পথ ধরা নেতাদের মধ্যে প্রথম হলেন সেই মুকুল রায়। মুকুল রায় পুত্র শুভ্রাংশুকে নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। তারপরই তৃণমূল-মুখী যোগদান শুরু হয়। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলের ফেরার লাইন পড়ে যায়।
মুকুল অনুগামীরা ফিরতে শুরু করেন, ফেরেন রাজীবও
মুকুল রায়ের পথ ধরে তৃণমূলে ফেরেন বিজেপির চার বিধায়ক। বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তন্ময় ঘোষ, বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায় এবং রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী যোগ দেন তৃণমূলে। তৃণমূলে ফেরেন সব্যসাচী দত্ত। আর তৃণমূলে ফেরেন বহু আলোচিত রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া সাংসদ সুনীল মণ্ডল ফিরে আসেন তৃণমূলে। এমন অনেক নামই ফের তৃণমূলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে, যাঁরা একুশের আগে তৃণমূল ছেড়েছিলেন।
একুশে দলবদলে বিরাট হইচই ফেলে দেন বাবুল সুপ্রিয়
আর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে ফের ঘরওয়াপসি হয়েছে তেমন নেতা বা নেত্রী বাদে যাঁর দলবদল নিয়ে একুশে বিরাট হইচই হয়েছিল, তিনি বলেন বাবুল সুপ্রিয়। প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী তথা বিজেপির সাংসদ। তিনি বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় তিনি বাংলার রাজনীতি করার বিষয়ে মনস্থ করেছেন।
ভিনরাজ্যের দলবদলে যাঁরা তৃণমূলমুখী হন একুশে
তৃণমূল একুশে বঙ্গ-বিজয়ের পর পাখির চোখ করেছে ভিনরাজ্যে সংগঠনে। সেইমতো ত্রিপুরা ও গোয়াকে লক্ষ্য করে তাঁরা দল সাজাতে শুরু করেছে। এই দুই রাজ্যের মুখ হিসেবে কংগ্রেস থেকে তাঁরা ছিনিয়ে এনছেন যথাক্রমে সুস্মিতা দেব ও লুইজিনহো ফেলেইরোকে। তাঁদের পাশাপাশি আরও অনেক নেতা যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। সেই তালিকায় রয়েছেন কংগ্রেসের সুবল ভৌমিক, কীর্তি আজাদ, অশোক তানওয়ার, জেডিইউয়ের পবন বর্মা, এনসিপির আলেমাও চার্চিল, মেঘালয়ে মুকুল সংমা-সহ ১২ জন বিধায়ক প্রমুখ।