জাতের নামে বজ্জাতির জুয়া খেলা, প্রাণ গেলেও থাকবে মনুষ্যত্ব, অন্ধকারেও আলোর সন্ধান
পশ্চিমবঙ্গে জাতি হিংসা কোনওদিন ছিল না এমনটা কেউ-ই দাবি করবে না। কিন্তু, ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বঙ্গ দেখেছিল দুই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা একটা হল নোয়াখালি অর অন্যটি কলকাতায়।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার হার এই মুহূর্তে কত? বা কেউ এক চান্সে বলতে পারবেন পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে কর্মসংস্থানের সঠিক ছবিটা? অথবা একবার ভাবার চেষ্টা করুন সেই সব মানুষগুলোর কথা যারা চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে তাঁদের সর্বস্ব খুঁইয়েছেন। এঁরা এখন কি অবস্থায়, কোথায় আছেন? কেউ সঠিক সংখ্যাটা কী বলতে পারবেন? আরও একটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন এই প্রশ্নে, যেমন গত কয়েক বছরে এই রাজ্যের বুকে মধ্য বয়সে কত মানুষ তাঁর রুটি-রুজি হারিয়েছেন?
সন্দেহ নেই যে রাজ্যে এখন সংবাদমাধ্যম জুড়ে থাকে খেউড় রাজনীতির গপ্পো আর গ্ল্যামারের উষ্ণতায় চুইয়ে পড়া সেক্সের সুড়সুড়ি। আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন এতেই অভ্য়স্ত। 'ডিজিটাল এজ' আসার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল- শব্দের অনেকে অনেক রকম-ফের বানিয়েছেন। তাই এখন ভাইরাল নিউজের দাপাদাপি। তাই রামনবমীর মিছিল নিয়ে যে জাতি হিংসায় বিধ্বস্ত রানিগঞ্জ ও আসানসোল তাতেও লেগে গিয়েছে ভাইরাল নিউজের তকমা।
পশ্চিমবঙ্গে জাতি হিংসা কোনওদিন ছিল না এমনটা কেউ-ই দাবি করবে না। কিন্তু, ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বঙ্গ দেখেছিল দুই ভয়ঙ্কর দাঙ্গা একটা হল নোয়াখালি অর অন্যটি কলকাতায়। ভারতের জাতি হিংসার ইতিহাসে এই দুই দাঙ্গা কুখ্যাত বলে আজও স্মরণ করা হয়। এরপর যে পশ্চিমবঙ্গে জাতি হিংসা হয়নি তা নয়, তবে তা পরিসরে ছিল অনেক ছোট আকারে। অধিকাংশক্ষেত্রেই নিছক গোড়ামি আর কিছু মানুষের উস্কানি থেকে এইসব হিংসা সংঘঠিত হয়েছিল। এতে সেভাবে বৃহত্তর রাজনৈতিক ইন্ধন ছিল এমনটা কেউই দাবি করার হিম্মত দেখায় নি।
কিন্তু, জাতের নামে রাজনীতির উন্মাদনা বৃদ্ধি পেতেই এখন হিংসার বাড়-বাড়ন্ত। সম্মুখসমরে তৃণমূল বনাম বিজেপি। কে বেশি হিন্দুত্ববাদী তা প্রমাণ করতে যেন নেমে পড়েছে দুই দল। তাই গৈরিক বেশ ধারণ করে কিছু তৃণমূল নেতাকে নেমে পড়তে হয় পুরোহিত সম্মেলন থেকে গো-দানের মতো আসরে। আবার হিন্দু ধর্ম কতটা শক্তিশালী তা প্রমাণ করতে বিজেপি নেতা-নেত্রীদের হাতে তুলে নিতে হচ্ছে ত্রিশুল, তরোয়াল।
মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ রাজনীতির বড় পাশাখেলাটা খেলেছিল ইংরেজরা। আর সেক্ষেত্রে তাদের বড় হাতিয়ার ছিল ধর্মীয় ভাবাবেগ। স্বাধীন ভারতের একুশ শতকেও যে ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে রাজনীতির পাশাখেলা শেষ হয়নি তার বড় প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীকে ঘিরে তৈরি হওয়া অশান্ত পরিস্থিতি। ইংরেজদের স্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। যাদের আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক মনোভাবের ধারক এবং বাহক বলে চিহ্নিত করি।
আর ধর্মের নামে রাজনীতির কুস্তিগিরিতে সাধারণ মানুষ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ প্রশাসন নিছক ক্রীড়ানক। তাই ডিসিপি অরিন্দম দত্তকে অনায়াসে শিকার বানাতে পারে দুষ্কৃতীদের বুবি ট্র্যাপ করা বোমা। অনায়সে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সিবগাতুল্লাহ রশিদি-র শরীর। খুনিরা কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে এক কিশোরকে এভাবে খুন করতে পারে তা জানলে আঁতকে উঠতে হয়।
এক উঠতি কিশোরের ভয়ানক মৃত্যুতে আরও জটিল হতে পারত পরিস্থিতি। কিন্তু তা হয়নি সিবগাতুল্লাহ-র বাবা নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমাদাদুল্লাহ-র মনুষ্যত্বের প্রতি বিশ্বাস। আসলে রাজনীতির কারবারিরা যা দেখতে পান না, ইমাম সাহেব তা দেখেছিলেন। তাই পুত্রের নৃশংস হত্যার শোক বুকে করেও বলে উঠতে পেরেছিলেন-আল্লাহ তাঁর পুত্রকে যতদিন বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছিল ততদিন সে বেঁচেছে, তাঁর পুত্রকে যারা হত্যা করেছে তারা খুনি, তাই আইনের পথেই তাদের শাস্তি হবে, অন্য কোনও মানুষকে হত্যা করে পুত্রের হত্যার বদলা তিনি চান না, আর তার কথা কেউ না শুনলে তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার পথে পা বাড়াবেন।
আসলে ক্ষমতা দখলের মত্ততায় মেতে থাকা রাজনীতি ও ধর্মের কারবারীরা মনুষ্যত্বের এই ডাক শুনতে পাবেন না। কিন্তু তাঁদের বুঝতে হবে অন্ধকারের মধ্যেই আলো আছে। কিছুদিন আগেই দিল্লিতে প্রকাশ্যে খুন হয়েছিলেন অঙ্কিত সাক্সেনা। তাঁর মুসলিম প্রেমিকার পরিবারের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু, অঙ্কিতের বাবা যশপাল ধর্মের ভেদাভেদের এই হিংসা থেকে সকলকে বিরত থাকতে আহ্বান করেন।
অঙ্কিতের বাবার মতোই মনুষ্যত্বের পক্ষেই সওয়াল করেছেন খুন হওয়া মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সিবগাতুল্লাহ-র বাবা ইমাম মৌলানা ইমাদাদুল্লাহ। এঁরা বুঝিয়েছেন জাতের নামে যতই বজ্জাতি হোক, অন্ধকারে মনুষ্যত্বের আলো জ্বলবে। আর তা জ্বালবে কোনও না কোনও মানুষ। রাজনীতি আর ধর্মের মৌলবাদীরা কি কিছু শিক্ষা নিলেন!