বঙ্গের কোনও সেলেব্রিটি বিজেপিকে সমর্থন করলে অন্যদের গায়ে লাগছে কেন? এই 'নৈতিক পতন' আজ শুরু হয়নি
পশ্চিমবঙ্গে আজকাল সেলেব্রিটি শিবিরে একটি অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতদিন সিংহভাগ সেলেব্রিটিদেরই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কথা বলতে দেখা যেত।
পশ্চিমবঙ্গে আজকাল সেলেব্রিটি শিবিরে একটি অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতদিন সিংহভাগ সেলেব্রিটিদেরই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কথা বলতে দেখা যেত। এমনকি, আগে যাঁদের মানুষ সিপিএম বা বামেদের অনুগত হিসেবে দেখে এসেছে, সেই সব সেলিব্রিটিরাও ইদানিংকালে শিবির বদলেছেন। হয়তো পারিপার্শ্বিক চাপেই। কিন্তু দলীয় আনুগত্যের ব্যাপারে একদলীয় ব্যবস্থাই কায়েম ছিল মোটামুটি।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পর থেকে এই প্রবণতাটা বদলেছে। তৃণমূল এবং বিজেপি ২২-১৮ আসনে শেষ করার পরে একদলীয় ব্যবস্থাটি বেশ নড়ে গিয়েছে। অনেকেই বিজেপির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন খোলাখুলিভাবে; অনেকে আবার ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁরা এবারে অন্য কিছু ভাবতে চলেছেন। আবার এই ডামাডোলের মধ্যে এক শ্রেণী রয়েছেন যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন নিরপেক্ষ থাকার।
মেরুকরণের প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত সম্পর্কেও
বঙ্গের সুশীল সমাজে এক ক্রমবর্ধমান মেরুকরণের প্রভাব পড়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্কেও। সহকর্মী বিজেপির দিকে ঢলে পড়েছেন দেখে রেগে যাচ্ছেন কেউ কেউ। নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন; টাকা খাওয়ার অভিযোগও করছেন। অভিনয় এবং রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলার অভিযোগেও তর্জনী উঠছে।
এখানেই একটি প্রশ্ন ভাবায়। কেউ যদি কোনও দলকে সমর্থন করার কথা ভাবে, তাতে নৈতিকতার অধঃপতন হয়েছে, এমন বলার অধিকার বাকিদের কে দিল? যদি সেলেব্রিটি দুনিয়ার রাজনীতিকরণ আগেই হয়ে থাকে এবং তাই হয়েছে, তার পরে এখন নতুন করে "অমুক দলে যাওয়া মানে খারাপ হয়ে যাওয়া" জাতীয় মন্তব্য কী প্রমাণ করে? যে কোনও দলের প্রসাদ পাওয়ার লোভই নৈতিকতার অধঃপতন এবং সেই ট্র্যাডিশন যখন একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তখন একটি বিশেষ দলের দিকে আঙ্গুল তুলে বিশেষ লাভ হবে না। সেটা দ্বিচারিতারই সামিল।
সেলেব্রিটি শ্রেণীর মধ্যে তৈরী করা হয়েছে এক ধরনের লোভ
যখন তৃণমূল কংগ্রেস গাজর দেখিয়ে এই সেলেব্রিটি দুনিয়ার নানা ব্যক্তিত্বদের ভোটের ময়দানে নামিয়েছে, তখন কিন্তু প্রকাশ্যে এত নৈতিকতার প্রশ্ন শোনা যায়নি। কারণ সেটা করতে গেলে ওই সেলেব্রিটিদের একঘরে হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া, যেই ক্ষমতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লোভ বঙ্গের শাসকদল এই শ্রেণীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তাতে "না" করাও বেশ কঠিন কাজ ছিল। দেদার নির্বাচনী টিকিট বিলোনোর সময়ে সবাই যে উপকৃত হয়েছে তা নয়, এবং সেটা সম্ভবও নয়। আর সেই টিকিট না পাওয়া সেলিব্রিটিরা যদি আজ অন্য মঞ্চে সুযোগ খুঁজতে যান, তাহলে তাঁদের একা দোষ দিয়ে কী হবে? অবক্ষয়ের সূচনা আগেই করা হয়েছে এবং তা আজ চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে।
দুই দলের সমানে সমানে টক্কর পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ দেখেনি
আরেকটি দিক হল পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে প্রতিযোগিতার অভাব এবং তার ফলে এক ধরনের মানসিক স্থবিরতা জন্ম। স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক-সমাজ জীবনে যেহেতু একটি সময়ে একটি দলই ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে (কংগ্রেস তারপরে বাম এবং তারপর তৃণমূল), সেখানে দলীয় আনুগত্যের মধ্যে বিভাজন খুব চোখে পড়েনি। অন্য দলের সমর্থনকে দেখা হয়েছে এক সামান্য ব্যতিক্রম হিসেবে। কিন্তু এখন দু'টি দলের প্রায় সমানে-সমানে লড়াইতে সেই ব্যতিক্রম আর সামান্য নেই আর এটাই অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। ভারতের অন্যান্য অনেক প্রদেশেই সুশীল সমাজের মানুষরা নানা দলের সমর্থন করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম।
এই পরিবর্তনবিমুখতা কি বদলাবে?