একুশে বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল-বাম-কংগ্রেস জোট? সেরকম কিছু ঘটলে মমতার জনভিত্তি আরও নড়বড়ে হবে
আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ কোনদিকে এগোতে পারে, তার একটি আভাস যেন বুধবার, ২৬ জুন, পাওয়া গেল বিধানসভায়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়।
আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ কোনদিকে এগোতে পারে, তার একটি আভাস যেন বুধবার, ২৬ জুন, পাওয়া গেল বিধানসভায়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। বিধানসভায় এদিন বক্তব্য রাখতে গিয়ে মমতা বাম এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বের প্রতি "জয়েন্টলি" কাজ করার আহবান দেন। লক্ষ একটাই: বিজেপিকে আটকানো?
এমনকি তাঁর এই আহ্বানের জবাবে বিরোধীরা রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে দায়ী করলেও মমতা তাঁর সহজাত আগ্রাসী মনোভাব দেখাননি। দলের অন্যান্যরা এই অভিযোগ খণ্ডন করতে হৈ-চৈ বাধালেও মমতা নমনীয় অবস্থান নেন এবং এটাও বলেন যে তিনি মনে করেন না যে সিপিএম এবারের লোকসভা নির্বাচনে পরিকল্পনা করে তাদের সব ভোট বিজেপিতে পাঠিয়েছে। অথচ, এই কয়েকদিন আগেও তিনি এই অভিযোগেই অনড় ছিলেন। বিজেপি এবারের লোকসভা নির্বাচনে তাদের সর্বোচ্চ ১৮টি আসন পায়; বামেরা পায়নি একটিও। কংগ্রেস পায় দু'টি। তৃণমূলের ঝুলিতে আসে ২২টি।
উত্তরপ্রদেশ, বিহারেও দেখা গিয়েছে জোট যদিও তা দীর্ঘমেয়াদে টেকেনি
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অবস্থান কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিজেপির বিরোধিতা করে এর আগে উত্তরপ্রদেশের দুই আঞ্চলিক বৈরী সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি একসঙ্গে এসেছে; প্রতিবেশী বিহারেও বিজেপিকে ঠেকাতে হাত মিলিয়েছেন নীতীশকুমার এবং লালুপ্রসাদ। যদিও সাময়িক সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদে এই বন্ধুত্ব টেকেনি। বহুজন সমাজ পার্টির সুপ্রিমো মায়াবতী লোকসভা নির্বাচনের পড়ে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গ ত্যাগ করেছেন।বিহারেও একসঙ্গে বিজেপিকে হারালেও পরে নীতীশকুমার লালুর দলের হাত ছেড়ে সেই বিজেপির সঙ্গেই ফের ভিড়ে গিয়ে সরকার গঠন করেন।
বামেদের সঙ্গে মমতার জোট অভাবনীয় কাণ্ডই বটে
পশ্চিমবঙ্গে যদিও উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের মতো জাত-পাত-ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হয় না। মমতার ক্ষেত্রে বামেদের সঙ্গে তাঁর হাত মেলানোর ঘটনা সত্যি হলে তা হবে বেনজির কারণ নেত্রী সারাজীবন বামেদের সঙ্গে চূড়ান্ত রাজনৈতিক সংঘাতে লিপ্ত থেকেছেন। বামেদের থেকে তিনি মতাদর্শগতভাবে খুব দূরে তা বলা যাবে না কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বামেদের বিরামহীন বিরোধিতা করার ব্যাপারে তাঁর জুড়ি ছিল না। আজকে তাহলে তিনি বামেদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কি নিজের ভাবমূর্তি খর্ব করছেন না? পরে অবশ্য মমতা বলেন যে তিনি আসলে জোটের কথা বলছেন না, বলছেন বিধানসভা কক্ষ সমন্বয়ের কথা। কিন্তু তাতে কি কিছু আলাদা প্রতিপন্ন হল তাঁর ইশারা? বিধানসভায় এখন বিজেপির ক'টা আসন যে মুখ্যমন্ত্রী কক্ষ সমন্বয়ের কথা বলছেন? তাহলে কি তিনি অশনি সংকেত দেখছেন ২০২১-এর নির্বাচন প্রসঙ্গে?
কিন্তু অসাধ্যসাধনের পথে অন্তরায় রয়েছে অনেক
বামেদের সঙ্গে মমতার জোট অভাবনীয় কাণ্ড হলেও তা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রথমত, বামেরা তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পথে পা বাড়ালে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস তাতে বাধ সাধবে। বিশেষ করে অধীর রঞ্জন চৌধুরী যেখানে এখন দলের এক বড় দায়ভার পেয়েছেন, তিনি এব্যাপারে সহজে ছাড় দেবেন না। সোমেন মিত্রও কতটা মমতার প্রতি নমনীয়তা দেখান, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আর দ্বিতীয়ত, মমতার সঙ্গে জোট বাধতে গেলে বামেদের অবাঙালি নেতৃত্বও ছেড়ে কথা বলবে না। দলের 'ইডিওলগ'রা এ ব্যাপারে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে, মমতার এই আহ্বানকে তাঁর দুর্বলতা ভেবে তাঁকে অবজ্ঞা-উপেক্ষাই করবে সিপিএম।
তৃতীয়ত, যে সকল নেতারা বিগত কয়েক বছরে বাম শিবির ত্যাগ করে মমতার দলে ভিড় করেছিলেন, বামেদের প্রসঙ্গে মমতার নমনীয় অবস্থান দেখলে অসন্তুষ্ট হবেন তাঁরাও। তখন যদি নিজেদের অনুগতদের নিয়ে তাঁরা বিজেপিতে পাড়ি দেন, তখন মমতার দলের ভাঙন আরও বাড়তে পারে।
এবং সর্বোপরি, যে সকল মানুষ আজও মমতাকে ভোট দেন তাঁর 'অগ্নিকন্যা' ভাবমূর্তির জন্যে, তাঁরা যদি দেখেন যে তিনিও শেষ পর্যন্ত সমঝোতার পথে হাঁটছেন, তাহলে তাঁরা যে খুব খুশি হবেন, তা হলফ করে বলা চলে।
সব মিলিয়ে, ২০২১ সালে বিজেপিকে ঠেকাতে রাজ্যে তৃণমূল-বাম-কংগ্রেস মহাজোটের আশা খুব একটা অলীক নয়। কিন্তু তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা। এককালে বামেদের হারাতে রাজ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি জোটের সম্ভাবনার কথা আকছার শোনা যেত; যদিও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ ধারণ করেনি। এবারে কি সেরকম হতে পারে?
[আরও পড়ুন:বিধানসভায় কাটমানি বিতর্ক! মুখ্যমন্ত্রীর নিশানায় সাংবাদিকরাও]