তৃণমূলের পদাধিকারী বিজেপির প্রচারে! দলের ভূমিকায় ক্ষোভ হুগলিতে
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিচারে এবার বিধানসভা ভোটে হুগলি জেলায় চমক দেখাতে চাইছে বিজেপি। সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, স্বপন দাশগুপ্ত (যিনি প্রার্থী হওয়ার পর রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন) থেকে শুরু করে অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত, প্রবীর ঘোষাল, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো তৃণমূলত্যাগী বিদায়ী বিধায়ক ও তৃণমূলের পদাধিকারীরাও বিজেপির টিকিটে লড়ছেন। কিন্তু দল ছেড়ে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন তাঁদের এখনও সাসপেন্ড বা বহিষ্কার করেনি তৃণমূলের জেলা বা রাজ্য নেতৃত্ব। কেউ টিকিট পেয়েছেন, কেউ আবার টিকিট না পেয়েও নির্বাচনের প্রচার চালাচ্ছেন গেরুয়া শিবিরের হয়ে। দলের শৃঙ্খলার প্রশ্নে এমন গা-ছাড়া মনোভাব দেখে ক্ষোভ বাড়ছে নীচুতলায়।
সুমনাকে নিয়ে চর্চা
বলাগড়ের প্রাক্তন বিধায়কের কন্যা সুমনা সরকার তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর অসন্তুষ্ট হয়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। কলকাতায় মুকুল রায়ের পাশে বসে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর ২ সপ্তাহ হতে চললেও এখনও তৃণমূলের কোনও পদ থেকে তাঁকে সরানো হয়নি। সুমনা জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি, হুগলি লোকসভা এলাকার তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি, দলের এসসি সেলের রাজ্য সম্পাদকের পদেও রয়েছেন। গত বছর হুগলি জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেস সভাপতি শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সহ সভাপতি করা হয়। তখনই হুগলি জেলার যুব সংগঠনকে তিন টুকরো করা হয়। শ্রীরামপুর লোকসভা এলাকায় যুব কংগ্রেস সভাপতি অরিন্দম গুঁই এবার বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হয়েছেন। সুমনাকে যুব সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় হুগলি লোকসভা এলাকায়। তার কয়েক মাস পর আরামবাগ লোকসভা এলাকার যুব সভাপতি করা হয় গোপাল রায়কে। সুমনা বা গোপাল তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় ঠাঁই পাননি।
ক্ষোভ বাড়ছে
সুমনা সরকার তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েও তৃণমূলের সব পদে বহাল এখনও! এতে ক্ষোভ বাড়ছে নীচুতলায়। ফেসবুকে ক্ষোভ উগড়েও দিচ্ছেন অনেকেই। দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও অনেকেই বলছেন, রক্তক্ষরণ উপেক্ষা করেও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে যেখানে পিছু হঠছে না সিপিআইএম-সহ বামেরা সেখানে শৃঙ্খলার প্রশ্নে তৃণমূলে কেন এমন গয়ংগচ্ছ মনোভাব? উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। যেমন, সিপিআইএম তাঁদের হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডল বিজেপিতে যাওয়ার আগেই বহিষ্কার করেছে। তৃণমূলে টিকিট না পেয়ে বাম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকে ফিরতে চাইলেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বিদায়ী বিধায়ক মঈনউদ্দিন শামস, এমন নজিরও রয়েছে। তাহলে কেন তৃণমূল শৃঙ্খলার প্রশ্নে কড়া হবে না সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
পিকে-র মুখ বাঁচাতেই?
হুগলি জেলায় তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলের কথা অজানা নয়। অনেকে নানা স্ট্র্যাটেজি নিয়েও কাজ না হওয়ায় দল ছেড়েছেন। কেউ আবার ছেড়েছেন প্রার্থী হতে না পেরে। বলাগড়ে যেমন সুমনাকে নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তৃণমূল সূত্রে খবর, প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শেই জেলায় যুব সংগঠন তিন ভাগে ভাগ করা হয়। শান্তনুকে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সহ সভাপতি হিসেবে পুনর্বাসন দেওয়ার পিছনেও অনেক 'খেলা' ছিল অভিযোগ। প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে যে সুমনাকে জেলার অন্যতন যুব সভাপতি করে আরও পদ দেওয়া হলো তিনিই বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তৃণমূলের মুখ তো পুড়েছেই। তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ, পিকে-র মুখ বাঁচাতেই দলবদলুদের বিরুদ্ধে কোনও অ্যাকশন হচ্ছে না।
দিলীপের সাফাই
দলবিরোধী কাজের জন্য বাঁশবেড়িয়া পুরসভার প্রশাসকের স্বামী সোনা শীলকে বহিষ্কারের কথা সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ঘোষণা করেছিলেন হুগলি জেলা তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদব। যদিও প্রথমে বিদায়ী মন্ত্রী তপন দাশগুপ্তর মঞ্চে থেকে এলাকায় কাজ করার দায়িত্ব পান সোনা, সম্প্রতি বহিষ্কৃত অবস্থাতেই তাঁকে দেখা যায় উত্তরপাড়ায় ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে একই মঞ্চে। অভিযোগ, আনুষ্ঠানিক বহিষ্কারের পর দলের পতাকা না নিয়েই তৃণমূলে কামব্যাক করেছেন সোনা শীল। পদে না থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করেছিলেন জেলা সভাপতি। অথচ তিনিই দলবদলুদের বিরুদ্ধে কিছুই করছেন না কেন, সেটাই বুঝতে পারছেন না অনেকে। এ বিষয়ে দিলীপ যাদব সাফাই দিয়ে বলেন, যাঁরা স্বেচ্ছায় দল ছেড়েছেন তাঁরা তো আপনাআপনিই বহিষ্কৃত! যাঁরা পদ পেয়েছিলেন তখন তো ফুলের স্তবক নিয়ে মিষ্টিমুখের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছিলেন। টিকিট না পেতেই তাঁরা দল ছেড়েছেন! সবাইকে তো টিকিট দেওয়া সম্ভব নয়। আমি নিজেও তো ২০০১ থেকে টিকিট পাইনি ২০১৬ অবধি। এবার পেয়েছি। অন্য বিধানসভা এলাকায় এসে গত ১৫ দিন ধরে যা সময় দিচ্ছি এলাকা চিনতে, আমার বিধানসভা এলাকায় দাঁড়ালে তো এতটা সময় লাগত না। আমরা সকলেই এখন ভোটের কাজে ব্যস্ত। যা করব রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েই করব।
অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা
প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষের জেরে জেলার অনেক নেতাই ভোটের কাজে সক্রিয় নন। ভোট কাটাকুটি 'খেলা'-র টার্নিং পয়েন্ট হতেই পারে। টিকিট না পাওয়া কয়েকজন বিধায়ক ও দলের পদাধিকারীর ভূমিকা যে আতস কাঁচের তলায় রয়েছে সে কথা জানিয়েছেন খোদ জেলা সভাপতি দিলীপ যাদব। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে যে ছবি উঠে আসছে তা হলো, তৃণমূলের পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটলেও দলকে 'শিক্ষা' দিতে তাঁদের অনেকেই জোড়াফুলে বোতাম টিপবেন না বলে ঘনিষ্ঠমহলে জানাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই নীচুতলার কর্মীরাও বিভ্রান্ত, অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা করছেন। দিলীপ যাদব যেমন বললেন, কয়েকজনের দিকে দলের নজর তো আছেই। কে কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে বসে খাচ্ছেন সব তথ্য আছে। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করাটাও কিন্তু দলের একটা কৌশল। দলবদলুদের ফের ঘরে ফেরার রাস্তা খোলা রাখতেই কি তাঁদের পদ থেকে সরানো হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ যাদব ইঙ্গিতপূর্ণ জবাব দিয়ে বললেন, তেমন সম্ভাবনা এখন নেই। পরে দেখা যাবে। তবে জেলার যুব সংগঠনকে যথাসময়েই ঢেলে সাজানো হবে। বিজেপির কটাক্ষ, এতেই তৃণমূলের দেউলিয়াপনা প্রমাণিত।
ছবি- ফেসবুক