বিদ্যাসাগর মূর্তি: নবজাগরণের জন্যে নবচেতনা চাই, তার ব্যবস্থা কি মমতা করেছেন কিছু?
মূর্তির পুনঃস্থাপন নিয়েও কম নাটক হয়নি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন যে বিজেপি পঞ্চধাতুর মূর্তি তৈরী করে দেবে ভেঙে দেওয়া মূর্তিটির জায়গায়। তাতে আপত্তি তোলেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা রেখেছেন। গত ১৪ মে উত্তর কলকাতায় বিজেপির তৎকালীন অধ্যক্ষ অমিত শাহের নির্বাচনী প্রচারের মিছিলের সময়ে সংঘর্ষে বিদ্যাসাগর কলেজের মধ্যে থাকা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ভেঙে ফেলা নিয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে চাপানউতোর চলতে থাকে মহামানবের মূর্তি ভাঙা নিয়ে। লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম এবং অন্তিম দফার আগে ঘটে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টির মধ্যে দিয়ে বাঙালি খণ্ড-জাতীয়তাবাদ উস্কে দিয়ে নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেও তাতে লাভ হয়নি। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এক ধাক্কায় ১৮টি আসন জিতে ইতিহাস কায়েম করে। তৃণমূল পায় ২২টি আসন।
এরপর মূর্তির পুনঃস্থাপন নিয়েও কম নাটক হয়নি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন যে বিজেপি পঞ্চধাতুর মূর্তি তৈরী করে দেবে ভেঙে দেওয়া মূর্তিটির জায়গায়। তাতে আপত্তি তোলেন মমতা; বলেন কারও থেকে ভিক্ষা তাঁর প্রয়োজন নেই।
এরপর গত মঙ্গলবার, ১১ জুন, একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফের প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যাসাগরের মূর্তি। বিদ্দ্বজনদের আমন্ত্রিত করে মমতা সেই নয়া মূর্তি ঘটা করে নিয়ে গিয়ে তাঁর উন্মোচন করেন। বক্তব্য রাখেন বিদ্দ্বজনরাও।
রাজনৈতিক ভাষণ কেন? তাতে সংকীর্ণতাই গুরুত্ব পায়
এই পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু তার পরেই মমতা দিতে শুরু করলেন রাজনৈতিক ভাষণ। একটি সামাজিক জোটের আহ্বান করে মমতা বলেন বাংলাকে গুজরাত বানানো চলবে না। এমনকি মঞ্চে সাহিত্যিক আবুল বাশারকে দেখিয়ে বলেন মুসলমান বলে কি তিনি বাশারকে তাড়িয়ে দেবেন? বঙ্গে পুনরায় নবজাগরণের ডাকও দেন মুখ্যমন্ত্রী।
ব্যাপার হচ্ছে, নবজাগরণের ডাক, বাঙালি ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি রক্ষার আহ্বান -- এ সবই ইতিবাচক নিঃসন্দেহে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক হিসেবে দিনের পর দিন যে অবক্ষয়ের মোকাবিলা করা থেকে বিরত থেকেছেন মমতা, তার দায় কে নেবে?
নবজাগরণের প্রয়োজন সব সমাজেরই রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুণ ধরে যাওয়া সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনদর্শনে নতুন করে ঝাঁকুনি দেওয়ার প্রয়োজন সব যুগেই আসে। কিন্তু সেই ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্যে যে জ্ঞান, নির্ভীকতা এবং যতটা বদ্ধপরিকর হওয়া প্রয়োজন, তার কতটুকু রয়েছে মমতাদেবীর রাজ্যে?
মমতা শ্রদ্ধা দেখাচ্ছেন শঙ্খ ঘোষকে যাঁকে চূড়ান্ত অপমান করেছেন তাঁরই এক হোতা
বর্ষীয়ান কবি শঙ্খ ঘোষকে মমতা আমন্ত্রিত করেছিলেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার মঞ্চে। অথচ এই শঙ্খ ঘোষকেই অতীতে কটাক্ষ করেছেন তাঁরই দলের এক ভোট-ম্যানেজার যা শুনে রাজ্যবাসীর মাথা হেঁটে হয়ে যায় লজ্জায়। শঙ্খ ঘোষকে আপত্তিজনকভাবে কটাক্ষ করার জন্যে দলের অন্যতম ওই হোতাকে মমতা কী বলেছেন বা আদৌ কিছু বলেছেন কি না, জানা নেই কিন্তু প্রশ্ন ওঠে: তাহলে কোন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে? একই সঙ্গে তো দু'টি থাকতে পারে না। হয় বিদ্যাসাগর থাকবেন, নয় তো অতল মূর্খামি। বিজেপি যেমন একই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী ও নাথুরাম গডসেকে রাখার প্রবণতা দেখায় যেটা আসলে দ্বিচারিতা, তৃণমূলের ক্ষেত্রেও সেই একই ধরণের দ্বিচারিতা দেখা যাচ্ছে।
নবজাগরণের জন্যে নবচেতনা চাই সবার আগে, তা কি বর্তমান বঙ্গে রয়েছে?
মনে প্রশ্ন জাগে তাই ফের: মমতা এই যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করলেন, এ কি সত্যিই ঊনবিংশ শতাব্দীর ওই মনীষীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার জন্যে নাকি ২০২১-এ যাতে বাঙালি আবেগে উস্কানি দিয়ে 'হিন্দিভাষী' বিজেপিকে অচ্ছুৎ করে নির্বাচনী বৈতরণী করা যায়, তার লক্ষ্যে? সামনের বছর বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০বছর পূর্তি। বিদ্যাসাগর কলেজের মূর্তি ভাঙার আগে তাঁকে নিয়ে কোথাও কিছু চোখে পড়েনি। আর এখন হঠাৎ প্যান্ডেল,ফেস্টুন, স্লোগান, মিছিল-এর রমরমা।
রাজনীতি কি ফের অরাজনৈতিককে গিলে খেল?