নুসরত এখন দেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র; সিঁদুর-চূড়া পরে মাঠের বাইরে ফেলছেন ভণ্ড হিন্দুত্ববাদীদেরই
চিত্রাভিনেত্রী নুসরত জাহান যখন এবছরের লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাট থেকে মনোনয়ন পান, তখন অনেকেই তাঁকে নিয়ে হেসেছিলেন।
চিত্রাভিনেত্রী নুসরত জাহান যখন এবছরের লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাট থেকে মনোনয়ন পান, তখন অনেকেই তাঁকে নিয়ে হেসেছিলেন। এরা তো মজা দেখতে রাজনীতিতে আসে, কত সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি কটাক্ষ তাঁকে করা হয়, সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতে তাঁর সহকর্মী মিমি চক্রবর্তীকেও একইভাবে নিশানা করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্ল্যামার জগতের লোকজনকে নির্বাচনের টিকিট আকছারই দিয়ে থাকেন। তাঁর সময়ে যত তারকা নির্বাচনে জিতেছেন, তত ভারতের আর কোনও প্রান্তে কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কেউ জিতেছেন কি না সন্দেহ। কিন্তু অন্যান্য যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের সঙ্গে নুসরতের এক বড় পার্থক্য চোখে পড়ছে। সেটা তিনি সুন্দরী বলে বেশি পাদপ্রদীপের আলোয় আসছেন কি না তা জানা নেই, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে নুসরত এই কয়েকদিনের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কারণটা রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক।
নুসরত রাজনীতিতে নতুন, কিন্তু নির্বোধ নন
নুসরত রাজনীতিতে নতুন হলেও তিনি যে নির্বোধ নন, তা ইতিমধ্যেই বোঝা গিয়েছে। আর অন্যদিকে বোঝা গিয়েছে তাঁকে নিয়ে ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির এক মহা দ্বিচারিতার কথাও।
নুসরত সংখ্যাগুরুবাদীদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছেন একপ্রকার
নুসরত মুসলিম হয়েও সিঁদুর-চূড়া পড়েছেন, এই বিষয়টি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীদের বেশ চমৎকৃত করেছে। মুসলমান হয়েও তিনি রথের দড়ি টানছেন, এতেও দারুন খুশি হিন্দুত্ববাদীরা যদিও তারা বুঝছে না যে এটা ঘুরিয়ে তাদের প্রবল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দাপটের গালেই চড়। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে একজন বিজেপির কর্মকর্তা নুসরতকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি যেখানে জৈন (তাঁর স্বামীর নাম নিখিল জৈন) সংস্কৃতিকে আপন করেছেন, তাঁর নেত্রী মমতা হিন্দু স্লোগান 'জয় শ্রীরাম' শুনে খেপে যাচ্ছেন কেন? এতে নুসরত ফুলটস বল মাঠের বাইরে ফেলার মতো করে দু'টি কথা বলেন। এক তো তিনি সব ধর্মের সংস্কৃতিকেই আপন করে নিতে ভালোবাসেন আর দ্বিতীয়ত, কাউকে দিয়ে জোর করে 'জয় শ্রীরাম' বলানোর পন্থাটিতে তিনি বিশ্বাসী নন। অর্থাৎ, ঘুরিয়ে বললেন যে মমতার আপত্তি সেখানেই যে বাংলায় আজকে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে।
নুসরত নির্বাচনের প্রচার চলাকালীনও তিন তালাকের বিরোধিতা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি মস্তিষ্ক ব্যবহারে অনীহা দেখান না। আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে দলতন্ত্রের প্রবল দাপটে ব্যক্তি মতামতের জায়গা সংকুচিত হলেও নুসরত দেখিয়েছেন যে তিনি তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে ভীত নন। যদিও তাঁকে "বাচ্চা মেয়ে, কিছু বোঝে না" জাতীয় কথা বলে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছেন খোদ তাঁর দলনেত্রীই, কিন্তু নির্বাচনের পরেও তাঁকে নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে নিজের 'ইনক্লুসিভ' পরিচয় নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হয়েছেন নুসরত নানা মঞ্চে, তাতে তাঁর প্রশংসা না করা অনুচিত কাজ হবে।
দেশের ব্যর্থ উদারবাদীদের নুসরতের কাছে শেখা উচিত
নুসরত মুসলমান হয়ে সিঁদুর পরে কিন্তু একটি বড় কাজ সাধন করেছেন আর তার জন্যে দেশের ব্যর্থ উদারবাদীদের তাঁর কাছে ঋণী থাকা উচিত। নুসরত হিন্দুত্ববাদীদের তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে আদতে এই সংখ্যাগুরুবাদীরা কতটা ভণ্ড এবং সংকীর্ণ। মুখে হিন্দুবাদের কথা বললেও এই ধ্বজাধারীরা এই ভেবেই আপ্লুত যে একজন মুসলমান মহিলা সিঁদুর-চূড়া পড়েছে। তিনি কিন্তু সেটা নিজের স্বাধীনতায় করছেন, তাঁর উপরে তা চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ, যে গা-জোয়ারি রাজনীতিটি আজ এদেশের হিন্দুত্ববাদীরা করছে, তা যে আসলে হিন্দুবাদের তথাকথিত উদারবাদের সঙ্গে কোনওরকমভাবেই মানানসই নয়, তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন নুসরত। তিনি একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও অন্য ধর্মকে আপন করে ভণ্ড হিন্দুত্ববাদীদের এটা মেনে নিতে বাধ্য করেছেন যে ব্যক্তিস্বাধীনতার মাধ্যমেও মানুষ সঠিক পথে চলতে পারে। কাউকে জোর করে অন্য ধর্মের স্লোগান বলানোতে হিন্দুধর্মের কোনও কৃতিত্ব নেইম তা গুণ্ডাগিরিরই নামান্তর মাত্র।